সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ থেকে সমাজকে বাঁচাতে হবসের এই ধারণার প্রেক্ষাপট হলেও বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর প্রকাশিত সংবাদ দেশে যে ‘বিশৃঙ্খলা’ ও ‘ছায়াযুদ্ধে’র কথা বলছে, তার সঙ্গে এর মিল-অমিল দুটিই আছে। বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের নিরাপত্তাহীনতার বোধ ক্রমবর্ধমান, ‘দলীয় মব সন্ত্রাস’ কিংবা অরাজকতার খবর যখন নিত্যসঙ্গী, তখন হবসের এই তত্ত্ব নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা, উপদেষ্টাদের বিতর্ক ও তাদের টেবিলে ‘সমন্বয়ক’দের তদবিরের উঁচু ফাইল, আদালতের গুণমানের ক্রমাবনতি এবং সেনা-অবস্থান ইত্যাদি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সামাজিক চুক্তি কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অসাড় হয়ে পড়েছে সমাজে নাগরিকদের সমদর্শিতারূপে গণ্য করার দৃষ্টিভঙ্গিটির।
কেন এই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, তার কারণটি অনুধাবন করা খুব কঠিন নয়। কারণ, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার, তা এই সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠার একটি দিক মাত্র। গণতন্ত্রের এই পুরোনো ও আনুষ্ঠানিক দিকটি যেখানে নির্বাচন ও ব্যালটকেই গুরুত্ব দেয়। কিন্তু যাঁরা পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশমান ধারাটি অনুসরণ করেন, তাঁরা এর অন্যদিকটি আলাপ–আলোচনাভিত্তিক শাসনের ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গিটি, এ দেশে যে নেই সেটি জেনে থাকবেন। অগ্রসর পাঠক উপলব্ধি করবেন যে এক মাথা, এক ভোটের দাবি হিসেবে গণতন্ত্রকে এখন আর গণ্য করা হয় না, বরং দেখা হয় তার চেয়ে ব্যাপক প্রশস্ত আকারে।
স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতে, গণতন্ত্রের সারবস্তু হলো অবাধ, মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যা এর অপরিহার্য অঙ্গ। হান্টিংটন-উত্তর সময়ে অনেক পরিবর্তন হলেও এখনো অনেকে গণতন্ত্রকে, সাংগঠনিক রূপের বাইরে অর্থাৎ ব্যালটের আরেক নাম গণতন্ত্র হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, এর বাইরে ভাবতে রাজি নন। গুরুত্ব বিবেচনায় ভোট কম কিছু নয় বরং প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনা ও যুক্তিপ্রয়োগকে কার্যকর করতে গেলেও ভোটের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এটি প্রয়োজনীয় শর্ত মাত্র, কিছুতেই তা এর ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। আর তা ছাড়া ভোটের কার্যকারিতা তখনই থাকে, যখন নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের অধিকার, জীবনরক্ষাকারী প্রাথমিক দ্রব্যের সমঅধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে।