‘১৪ বছর বয়সী একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী পাগলের মতো জীবন যাপন করছি। আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনের হাফেজ ছিলো। ওর কি অপরাধ ছিলো? আমি আসামীদের ফাঁসি চাই।’
জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদের বাবা শেখ জামাল হাসান আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হয়ে এই জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে শেখ জামাল হাসান বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ মোস্তাকিম (১৪)। আমার ছেলে গেন্ডারিয়া উইল পাওয়ার স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিলো। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি, আমার ছেলে এবং আমার পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমার স্ত্রী এবং সন্তানেরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলো। গত ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক ১০ টা ৪৫ মিনিটে আমার ছেলে শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ তার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমরা তখন বাসায় ছিলাম। আমার স্ত্রী এবং মেয়েও বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা আনুমানিক ১ টা ৪৫ মিনিটের সময় আমার শ্যালক আসিফ আমার মোবাইল ফোনে কল করে আমাকে বলে আমার ছেলে মোস্তাকিম গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি তাকে খুঁজতে বাসা থেকে বের হয়ে গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে এবং আজগর আলী হাসপাতালে খুঁজতে থাকি। বেলা আনুমানিক ২ টার সময় আমার ভাতিজি সম্পা আমার মোবাইল ফোনে কল করে আমাকে বাসায় যেতে বলে এবং বলে মোস্তাকিমের লাশ বাসায় আসছে। আমি বাসায় গিয়ে দেখি আমার ভাই আব্দুর রহমানের ফ্লাটে আমার ছেলে মোস্তাকিমের নিথর দেহ পড়ে আছে। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম তার বাম চোখে গুলি লেগে মাথার পিছন দিকে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে যায়। আমি ওখানে আমার ছেলের বন্ধু সিয়াম এবং রূপগঞ্জের আব্দুর রউফসহ আরো কয়েকজন ছাত্রকে দেখতে পাই। তখন সিয়াম বলে আমার ছেলে চানখারপুল নবাব কাটারা এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের পিছনের রাস্তার উপর মিছিলরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। সে আরো জানায়, শেখ বুরহানউদ্দিন কলেজের দিক থেকে পুলিশ মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে এবং সেই গুলিতে আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। আব্দুর রউফ বলেন, সে ও সিয়ামসহ আরো কয়েকজন ছাত্র মিলে রিকশাযোগে আমার ছেলেকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সে আরো জানায় যে, হাসপাতালের ডাক্তারদের পীড়াপীড়িতে তারা দ্রুত আমার ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসে। ডাক্তাররা বলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে লাশ হাসপাতালে রাখা যাবে না। তাড়াতাড়ি লাশ না নিয়ে গেলে তারা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে দিবে বলে হুমকি দেয়। তাদের সাথে ডাক্তাররা খারাপ ব্যবহার করে। তারপর আসরের নামাজের পরে আমার ছেলের লাশ জানাজার জন্য ধুপখোলা মাঠে নিয়ে যাই। সেখানে শেখ শাহারিয়ার খান আনাসের লাশও আনা হয়। সেও চানখারপুলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। জানাজা শেষে দুজনকেই গেন্ডারিয়া জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জবানবন্দিতে শেখ জামাল হাসান বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা থানার এডিসি আক্তারুল ইসলাম, মোঃ ইমরুল, এরশাদের নির্দেশে ৪০/৫০ জন পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করে। এর মধ্যে কনস্টেবল সুজন এবং নাসিরুল টার্গেট করে আমার ছেলেকে এবং মিছিলের উপর গুলি করে। পুলিশের গুলিতে শাহরিয়ার খান আনাস, ইয়াকুব, রাকিব, মানিকসহ আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
শেখ জামাল হাসান তার জবানবন্দিতে বলেন, আমি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিওর মাধ্যমে আসামীদের নাম জেনেছি। ভিডিওগুলো আমি আমার মোবাইলে সংরক্ষিত রেখেছি। সেখানে আমার ছেলের রক্তাক্ত অবস্থার ভিডিও আছে। (এ সময় সাক্ষী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন)। আমি শুনেছি সুজন আমার ছেলেকে গুলি করেছে। আমি যখন আমার ছেলেকে দেখতে পাই তখনও তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো। আমার ছেলেকে গুলি করার ভিডিও আমার কাছে আছে। আমার ১৪ বছর বয়সী একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে আমি আমার স্ত্রী পাগলের মতো জীবন যাপন করছি। আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনের হাফেজ ছিলো। ওর কি অপরাধ ছিলো? আমি ছেলে হারানোর বেদনায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। আমি আসামীদের বিচার চাই। আমি আসামীদের ফাঁসি চাই।
এই সাক্ষীর আগে মঙ্গলবার বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন রাজধানীর বোরহান উদ্দিন কলেজের শিক্ষিকা আঞ্জু আরা ইয়াসমিন।এই মামলায় ট্র্যাইব্যুনাল পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আগামীকাল দিন ধার্য করেছেন।
আজ ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউসন পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। আজকের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটরসহ অপর প্রসিকিউটর ও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটর সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর শহীদ আনাসের বাবা তার সাক্ষ্য দেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ১৪ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন।
এই মামলায় যে আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তারা হলে: সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।
এই আসামির মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক। অন্য চারজন গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার চারজনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।