পরিবর্তনের নববর্ষ | চ্যানেল আই অনলাইন

পরিবর্তনের নববর্ষ | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে বাঙালির সার্বজনীন লোক উৎসব নববর্ষের আয়োজনেও পড়েছে তার প্রভাব। এবার আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে সেই আবহ ধারণ করে- নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান। তাপদাহ আর ঝোড়ো বাতাসে নতুন দিনের ডাক দিয়েছে নববর্ষ। বাঙালি মেতেছে সেই উৎসবের রঙে, নতুন সাজে, নব চেতনায়। পুরনো বছর চৈত্র সংক্রান্তিকে বিদায় জানিয়ে বরণ করে নেয়া হয়েছে নতুন বছর।

বাংলা নতুন বছর ১৪৩২ সনের প্রথম দিন ১লা বৈশাখ। এই দিনটি আপামর বিশ্ব বাঙালির চিরায়ত আবেগ, নিজস্ব জাতী সত্ত্বার শেকড়ের অনুসন্ধান এবং হৃদয় নিঃসৃত ভালবাসার প্রতীক। এটি হাজার বছরের বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানা রঙে, ঢঙে, ছন্দে, আনন্দে নতুন বছরকে বরণ করে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান। আবহমানকালের রীতি অনুযায়ী দিনটি উদযাপনে সরকারী ছুটি উপভোগ করছে বাংলাদেশীরা।

সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত ও সরকারী উদ্যোগে নববর্ষ পালনের নির্দেশনা জারী করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথমবারের মত সকল মাদ্রাসায় দিবসটি উদযাপনে সমন্বিত নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড।

এবার নববর্ষ পালনে এসেছে নতুনত্ব। অনুষ্ঠান উদযাপনে চিরায়ত ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজনেও ব্যতিক্রমী ছোঁয়া লেগেছে। আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে আয়োজিত অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে চলতি বছর রাখা হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। যদিও এই নামে পূর্বেও ছিল। তা আবারো ফিরিয়ে আনা হয়। গেলো ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে এটি চূড়ান্ত করা হয়। এই শোভাযাত্রার নাম বদলের ব্যাপারে জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, অনেকেই জানেন- ১৯৮৯ সালে আমরা এই বর্ষবরণ প্রথা শুরু করেছিলাম আনন্দ শোভাযাত্রা নামে। পরে তা মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়। এবার আমরা মূল নামে ফিরিয়ে এনেছি এই শোভাযাত্রাকে।’

সকাল ৯টায় আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ, রাজু ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর ও বাংলা একাডেমি ঘুরে আবারো চারুকলায় এসে শেষ হয়। শোভা যাত্রার সময় বাংলামোটর, বারডেম, পলাশী ও মৎস ভবন থেকে শাহবাগের দিকে আসার রাস্তা বন্ধ ছিল। সাধারণ মানুষ নীলক্ষেত ও পলাশীর দিক দিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে প্রবেশ করে। র‍্যালি চলাকালীন সময়ে রমনা উদ্যানের সকল গেট, ছবির হাট, রাজু ভাস্কর্যের পেছনের গেটসহ রমনা কালীমন্দিরের গেট বন্ধ ছিল।

এবারের আনন্দ শোভাযাত্রার সামনে ২০টি সুসজ্জিত দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া এবং এর পেছনে ছিল ঐতিহ্যবাহী রিকশার বহর। সর্বস্তরের মানুষ পেছনের দিক থেকে এবারের আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নেন।

সকল ধরনের নাশকতা এবং নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে সকাল ৮টা থেকে দুপুর পর্যন্ত শাহবাগ ও টিএসসি মেট্রোরেল স্টেশন বন্ধ ছিল। এ সময় স্টেশনগুলোতে যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ থাকে এবং শোভাযাত্রা শেষ হলে স্টেশনগুলো পুনঃরায় চালু করে দেয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্য সকল আয়োজনে অংশ নিতে পলাশী ও নীলক্ষেত সড়ক দিয়ে প্রবেশ করতে পেরেছে শিক্ষার্থী ও সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। সকলে নিজেদের পরিচয় পত্র নিয়ে উৎসব এবং অন্য সকল কর্মসূচীতে অংশ নেয়।

এই বছর আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নেয় প্রায় ৩০টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এছাড়া সকল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, রিকশার বহর, বাউল এবং সাধুশিল্পী দল, অ্যাক্রোব্যাটিক শিল্পীগোষ্ঠী, পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্পীগোষ্ঠী, বামবা ব্যান্ড শিল্পীগোষ্ঠী, কিশোর ব্যান্ড, কৃষকদল, মূলধারার শিল্পীগোষ্ঠী, সাধনা নৃত্যসংগঠন, রংধনু পোশাক শ্রমিক শিল্পী দল, নারী ফুটবল দল এবং ঘোড়ার গাড়ির বহর অংশ নেয়।

এবারের আনন্দ শোভাযাত্রার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বড় মোটিফে সাতটি ফ্যাসিবাদের মুখ। তাই ফ্যাসিস্টের এই মোটিফ দেখতে ভোর থেকে ভীড় জমায় কৌতুহলী মানুষ। এর সঙ্গে শান্তির পায়রা, মুগ্ধ পানির বোতল, ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের প্রতি সহমর্মিতার প্রতীক এবং তাদের পতাকার মোটিফ তরমুজের ফালি, ইলিশ মাছ, কাঠের বাঘ এবং পালকি সবার নজর কাড়ে। মাঝারি মোটিফগুলোতে মধ্যে ছিল ১০টি সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, ২০টি রঙিন চরকি, ৮টি তালপাতার সেপাই, ৫টি পাখি, ৪টি পাখা, ২০টি ঘোড়া এবং ১০০টি লোকজ চিত্রাবলি। আর ছোট মোটিফগুলোর মধ্যে ছিল ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখ, ২০০টি বাঘের মুখ, ১০টি পলো, ৬টি মাছ ধরার চাই, ২০টি মাথাল, ৫টি লাঙল ও ৫টি মাছের ডোলা।

তবে এবারের আনন্দ শোভাযাত্রাকে ঘিরে শুরুতেই ষড়যন্ত্র ও নাশকতার ঘটনায় আশ্চর্য হন দেশবাসী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে প্রস্তুত করা রাক্ষসী ফ্যাসিস্ট মুখাবয়ব ও শান্তির প্রতীক পায়রায় প্রতিকৃতি শুক্রবার ১১ এপ্রিল গভীর রাতে পুড়িয়ে দেয় নাশকতাকারীরা। তাই বলে দমে যাননি কারু শিল্পীরা। চারুকলা অনুষদের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা নতুন করে তা আবার প্রস্তুত করে। তবে অল্প সময়ে কতটুকু প্রস্তুত করতে পারবে সেই সন্দেহকে পেছনে ফেলে সফল হন শিল্পীরা।

তবে এই নাশকতার সাথে জড়িতদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের সনাক্ত করা হয়েছে। তাদের শিগগিরিই গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ, ডিএমপি’র কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী।

এছাড়া এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে আনন্দ শোভাযাত্রা করায় অনেকে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। মঙ্গল শোভাযাত্রার ইউনেস্কোর স্বীকৃতির বিষয়েও প্রশ্ন তুলছেন।

আর পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় বিভিন্ন সাংস্কৃতি সংগঠনও অংশ নেয়। রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার ১৪ এপ্রিল সকাল সোয়া ৬টা থেকে শুরু হয় মূল পরিবেশনা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও নববর্ষ উদযাপিত হয় সফলতার সাথে।

এবারের নববর্ষ ১৪৩২ সফল করতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্মিলিতভাবে দায়িত্বশীলতা ও আবেগ নিয়ে কাজ করে।

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Scroll to Top