ঝড় থামার পর প্রকৃতি যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, অনেকটা তেমনি হয়েছে জাতীয় পার্টির অবস্থা। ভোটের ফলাফল বিপর্যয়ের পরদিন পার্টির কেন্দ্রীয় বনানী চেয়ারম্যানের কার্যালয় ছিল পুরোপুরি ফাঁকা।
সোমবার (৮ জানুয়ারি) ১১ টায় বনানী অফিসে গিয়ে কয়েকজন অফিস স্টাফ ছাড়া পার্টির কোন নেতাকর্মীকে পাওয়া যায় নি।
তিনতলা অফিসটিতে দুই দিক দিয়ে প্রবেশ করা যায়। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে ড্রইং রুম দিয়ে এগিয়ে গেলে ডান দিকের কোনায় মহাসচিব কক্ষ। সেই কক্ষের সামনে দিয়ে ওপরে উঠে গেছে সিঁড়ি। আবার মূল ভবনের বাইরে দিয়েও সিঁড়ির রুমে যাওয়া যায়। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেলেই প্রথমে পড়বে পার্টির চেয়ারম্যানের কক্ষ। এই তলায় আরও রয়েছে অতিথি কক্ষ, একটি মিনি হল রুমসহ মোট ৫টি কক্ষ। তৃতীয়তলায় কনফারেন্স রুম ও পাশেই প্রেস উইংয়ের জন্য নির্ধারিত অফিস।
নিচতলা ও দ্বিতীয়তলা শূন্য শুধু তৃতীয় তলায় ৩ জন অফিস স্টাফ ও চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারকে দেখা যায়। অফিসের মতো খাঁ-খাঁ করছে সামনের ১৭ নম্বর সড়কও। নেতাকর্মীরা না থাকলেও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ডিউটির চাপ না থাকায় তাদের আড্ডার মেজাজে দেখা গেছে।

দুপুর দেড়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন নেতাকর্মীর দেখা মেলেনি। তবে বিকেল নাগাদ পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ঢাকা-১১ আসনের প্রার্থী শামীম আহমেদ রিজভী এবং গুলশান থানা জাতীয় পার্টির সেক্রেটারী এসেছিলেন বলে জানা গেছে। পার্টির চেয়ারম্যান অবস্থান করছেন নির্বাচনী এলাকা রংপুরে, আর মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কিশোরগঞ্জে। তারা কবে ফিরবেন কেউই জানাতে পারেন নি।
পার্টির কার্যক্রম মূলত পরিচালিত হয় বনানী চেয়ারম্যানের কার্যালয় থেকে। কাকরাইল পাইওনিয়ার রোডে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকলেও সেখানে তেমন কার্যক্রম দেখা যায় না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যান থাকার সময় হঠাৎ হঠাৎ যেতেন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। যে কারণে অনেকটা জমজমাট ভাব ছিল। আবার চেয়ারম্যান যেতেন বলে পার্টির মহাসচিবও মাঝে মধ্যে অফিস করতেন। কয়েকজন সিনিয়র নেতা তখন নিয়মিত পার্টি অফিসে আসতেন, আড্ডা দিতেন। এখন তারাও আর নিয়মিত আসেন না।
একাদশ সংসদের তুলনায় আসন সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে জাতীয় পার্টির। একাদশে ২২টি আসনে জিতলেও এবার মাত্র ১১ আসনে জিতেছে। কারচুপির অভিযোগ এনে ভোটের দিনেও ১১ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভোটের পর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কোন প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হন নি। তিনি বার্তা২৪.কমকে পরে প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা বলেছিলেন।

পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের রংপুরে নির্বাচনের পরদিন সাংবাদিকদের বলেছেন, সার্বিকভাবে দেশের নির্বাচন ভালো হয়নি। সরকার যেখানে চেয়েছে, নির্বাচন নিরপেক্ষ করেছে, আবার যেখানে চেয়েছে, তাদের প্রার্থীকে জিতিয়েছে। তাই এ কারণে নির্বাচনে কেউ আসতেও চায়নি। আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না, তা আমি বলতে পারছি না। তবে আমার মূল্যায়নে সরকারের নিয়ন্ত্রিত এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কথা না।
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের আসনে থাকা দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এত নাজুক ফলাফলের মুখোমুখি হয় নি। ২০০১ সালে সবচেয়ে কম আসন ১৪টি পেয়েছিল জাপা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রথম জোটগতভাবে নির্বাচন করে ২০০৮ সালে। ওই নির্বাচনে ২৭ আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন দলটির প্রার্থীরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০ জন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে আরও ১৩ জনসহ ৩৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ, সব মিলিয়ে ২৭৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এরমধ্যে জোটগতভাবে ২১টি আরও উন্মুক্ত থেকে একটি আসনে বিজয়ী হয় জাতীয় পার্টির প্রার্থী।
এবারের নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল জাতীয় পার্টির ভূমিকা। নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে দলটির অবস্থান ছিল রহস্যজনক। ইলেকশন কমিশন ১৫ নভেম্বর তফসিল দিলেও নির্বাচন প্রশ্নে পার্টির অবস্থান ঝুলে রাখা হয় ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। ২০ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি তখনও অন্ধকারে রাখা হয়।

মনোনয়ন ফরম বিক্রির দিনগুলোতে পার্টির পক্ষ থেকে বলা হতো নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে রাখা হচ্ছে, জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা পরে জানানো হবে। অবশেষে ২২ নভেম্বর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানান দলটির মহাসচিব। ২৭ নভেম্বর ২৯৪ আসনে দলীয় প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। অন্যদিকে ছেলে সাদ এরশাদসহ অনুসারীদের আসন নিশ্চিত না হওয়ায় জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ২৯ নভেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
মনোনয়ন দাখিলের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে দলটির নেতারা। আসন ভাগাভাগি নিয়ে নানা রকম গুজব ছড়াতে থাকে। ওই দিনগুলোতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আবার ধোঁয়াশা ছড়িয়ে দেয় দলটির নেতারা। রটে যায় নির্বাচন বর্জনের গুজব, বিষয়টি পার্টির পক্ষ থেকেও রহস্যাবৃত্ত রাখা হয়। এ কারণে দলটির প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠ থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকে ১৭ ডিসেম্বর (মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার) পর্যন্ত। এতে করে অনেকেই নির্বাচনী দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়ে যান।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি। ওই আসনগুলো থেকে নৌকা সরিয়ে নেওয়া হয় আওয়ামী লীগ। ওই ঘোষণার পর থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন ২৬ আসনের বাইরে থাকা সাধারণ প্রার্থীরা। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক প্রার্থী পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করেছিলেন দলীয় ফান্ডের বিষয়ে। কিন্তু সাড়া না পেয়ে ক্ষোভ হতাশা নিয়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আবার নির্বাচনে পার্টির সমন্বয়হীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো।