দীর্ঘ পথচলায় যেমন ছিল উজ্জ্বল নক্ষত্র তামিম অধ্যায় | চ্যানেল আই অনলাইন

দীর্ঘ পথচলায় যেমন ছিল উজ্জ্বল নক্ষত্র তামিম অধ্যায় | চ্যানেল আই অনলাইন

২০২৩ সালের ৬ জুলাই, হঠাৎ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দেন তামিম ইকবাল। দ্রুতই অবশ্য অবসর ভেঙে ফেরেন। ফিরলেও জাতীয় দলের হয়ে খুব বেশি খেলার সুযোগ হয়নি, মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেন। সবধরনের ক্রিকেট থেকে প্রায় বছর খানেক বাইরে ছিলেন। এনসিএল টি-টুয়েন্টি দিয়ে সম্প্রতি মাঠে ফিরেছেন। বিপিএলের চলতি আসরে খেলছেন। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফর্মেও আছেন বেশ। তাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তার খেলা নিয়ে আলোচনা ওঠে। তামিম ফেরার বিষয়ে ভাবতে সময় নেন বিসিবি থেকে। শেষে জানালেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফিরছেন লাল-সবুজের কিংবদন্তি।

সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রংপুর রাইডার্সের কাছে ম্যাচ হেরে মেজাজ হারান। অ্যালেক্স হেলসের দিকে তেড়ে আচরণবিধি ভাঙার কারণে শুক্রবার তিরস্কারের পাশাপাশি এক ডিমেরিট পয়েন্ট শাস্তি পান তামিম। সেদিন রাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন তামিম। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার আক্ষেপ রেখেই বিদায়ের কথা জানান।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদায়ী পোস্টে লেখেন, “২০২৩ বিশ্বকাপের আগে যা হয়েছে, আমার জন্য তা বড় ধাক্কা ছিল, যেহেতু ক্রিকেটীয় কারণে আমি দলের বাইরে যাইনি। তার পরও আমি যেখানেই গিয়েছি, ক্রিকেট ভক্তদের অনেকে বলেছেন, আমাকে আবার জাতীয় দলে দেখতে চান। তাদের ভালোবাসার কথা ভেবেছি আমি। আমার ঘরেও একজন অনুরাগী আছে। আমার ছেলে কখনও আমাকে সরাসরি বলেনি, কিন্তু তার মাকে বারবার বলেছে, বাবাকে আবার দেশের জার্সিতে খেলতে দেখতে চায়। ভক্তদের হতাশ করার জন্য আমি দুঃখিত। ছেলেকে বলছি, ‘তুমি যেদিন বড় হবে, সেদিন বাবাকে বুঝতে পারবে।”

২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন তামিম ইকবাল। শাহরিয়ার নাফিসের সঙ্গী হয়ে ওপেনিংয়ে ব্যাটে নামা তামিম যদিও রাঙাতে পারেননি অভিষেক। অ্যান্টোনি আয়ারল্যান্ডের বলে গ্যারি ব্রেন্টের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সাজঘরে। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৮টি বছর। শেষ দুবছর দেশের জার্সিতে দেখা না গেলেও আগের ১৬ বছর দাপটের সঙ্গেই ক্রিকেট শাসন করে গেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আনতে যেকজন ক্রিকেটারের অসামান্য অবদান রয়েছে, তার মধ্যে তামিম উপরের দিকের একজন।

GOVT

বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার এবং সেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তামিম। বারবার পড়েছেন ইনজুরিতে। চোটের সাথে লড়াই করে ফিরেছেন, চোট নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মাঠে নেমেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার আগে দেশকে অনেককিছুই দিয়েছেন তামিম। ক্যারিয়ারজুড়ে রয়েছে অবিস্মরণীয় সব মুহুর্ত। কিছু কিছু মুহূর্ত চিরতরে গেঁথে আছে সমর্থকদের অন্তরে।

সবার আগে উঠে আসবে ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে তামিমের দুঃসাহসী সিদ্ধান্তের কথা। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটে নামে বাংলাদেশ। প্রথম ওভারে দুই উইকেট হারায়। দ্বিতীয় ওভারে সুরাঙ্গা লাকমলের বাউন্সারে পুল করতে গিয়ে কব্জিতে আঘাত পেয়ে আহত হয়ে মাঠ ছেড়ে সোজা হাসপাতালে চলে যান তামিম। হাতের কব্জিই নড়ে গিয়েছিল তামিমের।

ম্যাচের ৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে আউট হয়ে যান মোস্তাফিজুর রহমান। টাইগারদের খেলার জন্য বল তখনও বাকি ১৯টি। দলীয় রান ৯ উইকেটে ২২৯। এমন পরিস্থিতিতে মাঠে নামার তাড়না আসে চোটে ক্রিজ ছাড়া তামিমের। অবাক করে নেমেও যান, কব্জিতে ব্যান্ডেজ নিয়ে। সেট ব্যাটার মুশফিককে সঙ্গ দেন এক হাতে ব্যাট করেই। একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মুশফিক ঝড় তোলেন ব্যাটে। বাংলাদেশের ইনিংস থামে ২৬১ রানে। স্মরণীয় ম্যাচে টাইগাররা জয় পায় ১৩৭ রানের বড় ব্যবধানে।

এরআগে বলতে হয়, ২০১২ সালে এশিয়া কাপে তামিমের টানা চার ফিফটির ইনিংস নিয়ে। টুর্নামেন্টের আগে অবশ্য ফর্মে ছিলেন না তামিম। দলে নেয়া নিয়েও হয়েছিল জলঘোলা। তামিম সেবার ফিরেছেন বীরের বেশে, টানা চার অর্ধশতকে, ভিন্ন উদযাপনে। ‘এক-দুই-তিন-চার’ বলে চার আঙুলের সেই উদযাপন এখনও রয়েছে ক্রিকেট ভক্তদের মনে।

২০১৫ সালে পাকিস্তান সিরিজের আগে আরও একবার রানখরায় ছিলেন তামিম। চারপাশে রব উঠেছিল বাদ দেয়ার। তখনও ফিরেছিলেন তিনি দারুণভাবে, ২০৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে। পরের চার বছর ভাসান রানবন্যায়।

বাংলাদেশের হয়ে নানা অর্জনের পরে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব থেকে নিজ অধ্যায়ের ইতি টানলেন তামিম। দেখে নেয়া যাক, তামিম ইকবালের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কিছু অর্জন ও পরিসংখ্যান।

অভিষেক
ওয়ানডে: ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, হারারে স্পোর্টস ক্লাব, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।
টেস্ট: ২০০৮ সালের ৪ জানুয়ারি, ডানেডিন, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।
টি-টুয়েন্টি: ২০০৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর, নাইরোবির জিমখানা স্টেডিয়াম, প্রতিপক্ষ কেনিয়া।

ব্যাটিং রেকর্ড
ওয়ানডেতে ২৪৩ ম্যাচ খেলেছেন তামিম। এ ফরম্যাটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের মালিক তিনি। ৩৬.৬৫ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ৮,৩৫৭ রান। ৭৮.৫২ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১৫ সেঞ্চুরি ও ৫৬টি ফিফটি। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস ১৫৮ রান।

টেস্টে খেলেছেন ৭০টি। ৩৮.৩৯ গড়ে রান করেছেন ৫,১৩৪টি। রয়েছে ১০টি সেঞ্চুরি ও ৩১টি ফিফটি। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস ২০৬ রান।

টি-টুয়েন্টি খেলেছেন ৭৮ ম্যাচ। ২৪.০৮ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ১,৭৫৮ রান। ১১৬.৯৬ স্ট্রাইক রেটে হাঁকিয়েছেন ১টি সেঞ্চুরি এবং ৭টি ফিফটি। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস অপরাজিত ১০৩ রান।

ফিল্ডিং রেকর্ড
টেস্ট: ২০টি ক্যাচ।
ওয়ানডে: ৬৮টি ক্যাচ
টি-টুয়েন্টি: ১৮টি ক্যাচ।

বাংলাদেশের হয়ে যত রেকর্ড তামিমের
টেস্টে দেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক তামিম ইকবাল (৫,১৩৪)। তার চেয়ে ২৪ টেস্ট বেশি খেলে শীর্ষে মুশফিকুর রহিম (৬,০০৭ রান)।

টি-টুয়েন্টিতে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম (১,৭০১)। ২,৫৫১ রান নিয়ে শীর্ষে সাকিব। ২,৪৪৪ রান নিয়ে দুইয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২,০২০ রান নিয়ে তিনে লিটন দাস।

টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ২০৬ রান করে তামিম ইকবাল রয়েছেন তৃতীয় স্থানে। অপরাজিত ২১৯ রানের ইনিংসে দেশের শীর্ষে মুশফিকুর রহিম। ২১৭ রান করে দুইয়ে সাকিব আল হাসান।

ওয়ানডেতে এক ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রাহক তামিম, করছেন ১৫৮ রান। ১৭৬ রান করে শীর্ষে লিটন দাস।

টি-টুয়েন্টিতে তামিমের সর্বোচ্চ সংগ্রহ অপরাজিত ১০৩ রান। এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে একমাত্র সেঞ্চুরির মালিকও তিনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরাজিত ৮৮ রানও এসেছে তার ব্যাট থেকে।

টেস্টে দেশের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি করা ব্যাটার তামিম ইকবাল। সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ১০টি। ১৩টি সেঞ্চুরি করে শীর্ষে রয়েছেন মুমিনুল হক। ১১টি সেঞ্চুরি করে দুইয়ে মুশফিক। এই ফরম্যাটে ৪১টি ফিফটি রয়েছে তামিমের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬টি ফিফটি রয়েছে সাকিব আল হাসানের।

ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ১৪টি সেঞ্চুরির মালিক তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯টি করে সেঞ্চুরি সাকিব আল হাসান এবং মুশফিকুর রহিমের। একদিনের ফরম্যাটে সর্বোচ্চ ৫৬টি ফিফটি করে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান।

টি-টুয়েন্টিতে দেশের একমাত্র সেঞ্চুরির মালিক তামিম। ৭টি ফিফটি রয়েছে তার। সর্বোচ্চ ১২টি ফিফটি সাকিবের। ১১টি ফিফটিতে দুইয়ে লিটন।

দেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে লর্ডসে সেঞ্চুরি করেছেন তামিম। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরির ইনিংসটি লিপিবদ্ধ আছে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন ১০০ বলে ১০৩ রান করেন তামিম।

পার্টনারশিপ রেকর্ড
টেস্ট: ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনায় প্রথম উইকেট জুটিতে ইমরুল কায়েসকে সঙ্গী করে সর্বোচ্চ ৩১২ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন তামিম ইকবাল।

ওয়ানডে: ২০২০ সালে সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম উইকেট জুটিতে ২৯২ রান করেন তামিম ইকবাল এবং লিটন দাস।

টি-টুয়েন্টি: ২০১২ সালে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ ১৩২ রান করেন তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

অধিনায়ক হিসেবে তামিম
ওয়ানডে: ৩৭ ম্যাচ, জয়: ২১, পরাজয়: ১৪, ফল হয়নি: ২
টেস্ট: ১ ম্যাচ, জয়: ০, পরাজয়: ১

বিশ্বরেকর্ড
ওয়ানডে ক্রিকেটে কোনো নির্দিষ্ট ভেন্যুতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করার রেকর্ড তামিম ইকবালের। মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৮৫ ম্যাচ খেলে ২,৮৯৭ রান করেন তিনি। এরমধ্যে সেঞ্চুরি ৫টি। ফিফটি ১৯টি।

ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট (টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টুয়েন্টি) মিলিয়ে এক ভেন্যুতে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম। মিরপুর শের-ই-বাংলায় ১২৪ ম্যাচে তিনি করেছেন ৪,৫২৯ রান। শীর্ষে মুশফিক (১৫৫ ম্যাচে ৫,০০০ রান), দুইয়ে সাকিব (১৪৪ ম্যাচে ৪,৭৮৬ রান)।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ৬ষ্ঠ সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি রয়েছে তামিমের। ২০০৮ সালে মিরপুরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯ বছর ২দিন বয়সে সেঞ্চুরি করেছিলেন দেশসেরা ওপেনার। সেই ইনিংসে ১২৯ রান করেন।

অন্যান্য যেসব রেকর্ডের মালিক তামিম
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৯ বার শূন্য রানে আউট হয়েছেন তামিম। ১৮ বার আউট হয়ে দুইয়ে হাবিবুল বাশার সুমন।

বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭০টি টেস্ট খেলা ক্রিকেটার তামিম। সর্বোচ্চ ৮৬টি টেস্ট খেলেছেন মুশফিকুর রহিম।

বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলা ক্রিকেটার তামিম। খেলেছেন ২৪৩টি ম্যাচ। সর্বোচ্চ ২৭২টি খেলেছেন মুশফিক।

পরিশেষে, নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা ব্যাটার এবং সেরা ওপেনার তামিম ইকবালকে ছাড়া দেশের ক্রিকেট ইতিহাস কল্পনাও করা যাবে না। তিনি রবেন চিরকাল নক্ষত্র হয়ে।

Shoroter Joba

Scroll to Top