জুলাই বিপ্লবে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল আবিরকে হত্যা এবং নাহিদ হাসান ও সোহেল রানা নামে অপর দুই শিক্ষার্থীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বেধড়ক পেটানোর মামলায় পুলিশের দেয়া চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের পুনর্তদন্ত দাবির আবেদনের শুনানী রোববার।
চুড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে ওই মামলাটির প্রধান আসামি গুলশানের বিতর্কিত ব্যবসায়ী ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের সুবিধাভোগী ও দোসর তানভীর আলী ও তার সহযোগীদের ছাড় দেয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করতেই ওই পুনর্তদন্তের আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এডিশনাল পিপি) আজিজুল হক দিদার বলেন, রোববার (১০ আগস্ট) সিএমএম কোর্ট-৩ এ মামলাটির পুনর্তদন্ত দাবীর আবেদনের শুনানী হবে। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার ন্যায়বিচার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই ওই মামলা পুনর্তদন্ত দাবী জানানো হয়েছে।
পুলিশের দেওয়া ওই ফাইনাল রিপোর্ট বাতিল এবং পুনর্তদন্ত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ এ বছরের ১৭ জুলাই চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেয়া নারাজি আবেদনে উল্লেখ করেন, ‘তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা মনগড়া ও আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছেন। বাদি বা সাক্ষির কোনো ধরনের জবানবন্দি নেওয়া হয়নি। সাক্ষ্য-প্রমাণ সবই বিদ্যমান আছে।’
এদিকে, ওই শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে যোগ দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল প্রসিকিউটরিয়াল অ্যাডভাইজার এহসানুল হক সমাজী।
গত বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যসিস্ট আওয়ামী সরকার কর্তৃক নির্বিচারে গুলি, হত্যা-নির্যাতন ও দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবী আগস্টের ৫ তারিখে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনে যোগ দেয় শ্রমিক-পেশাজীবিসহ সকল স্তরের জনতা। গণপ্রতিবাদ ও আন্দোলনের তীব্রতায় সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তার বাসভবন ছেড়ে একটি হেলিকপ্টারে করে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। আন্দোলন রূপ নেয় বিজয়ের উৎসবে।
আন্দোলনকারীদের দাবীর প্রেক্ষাপটে দুইদিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরই মধ্যে গা-ঢাকা দিতে চেষ্টা করে দমন-পীড়নকারী পতিত শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ সদস্য এবং রাজনৈতিক কর্মীরা। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান সকল হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার বিচারের ঘোষণা দিলে দূর্ভোগের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা থানায় থানায় মামলা দায়ের করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গুলশানের কালাচাঁদপুরে নিহত আবিরের ঘনিষ্ট বন্ধু হাসান মাহমুদ বাদি হয়ে গত বছরের ১৮ আগস্ট গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে তানভীর অর্থ, অস্ত্র ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে সহায়তা করেছেন। গুলশান এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী এই তানভীর আলীর নির্দেশে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন বাবুলসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্র লীগের নেতাকর্মীরা বর্বর ওই হামলা চালিয়ে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকাল ৪ টার দিকে রাজধানীর গুলশানের কালাচাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে আন্দোলরত শিক্ষার্থী আবিরকে হত্যাসহ আরও কয়েকজনকে গুরুতর আহত করা হয়।
কিন্ত আব্দুল্লাহ আল আবির হত্যা মামলাটি মাত্র ৬০ দিনের মাথায় সব আসামিকে অব্যহতি দিয়ে আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয় পুলিশ। জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় এটিই প্রথম ফাইনাল রিপোর্ট। এতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ যুবলীগ ও ছাত্র লীগের ১০ নেতাকর্মীসহ সব আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া ওই মামলার প্রধান আসামি তানভীর আলীর বিরুদ্ধে অন্য আরেকটি ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। জুলাই আন্দোলনে রামপুরায় গুলিবিদ্ধ ভূক্তভোগী নাহিদ হাসান ট্রাইব্যুনালে অভিযোগটি দায়ের করেন।
গুলশানের আওয়ামী লীগ নেতা তানভীর আলী ও বাবুলসহ মোট ১০ জনের নাম উল্লেখসহ দেড় থেকে ২০০ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এজাহারভূক্ত অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শিমুল, গুলশান থানা ছাত্রলীগের নেতা আনিসুর রহমান সুজন, মানিক, সোহাগ, গুলশান থানা শ্রমিক লীগের মহসিন ওরফে কাকরা মহসীন, গুলশান থানা যুবলীগের জামিল হোসেন ও শহিদুল ইসলাম এবং গুলশান থানা আওয়ামী ওলামালীগ সহ-সভাপতি আব্দুল হামিদ।
মামলাটির তদন্ত করেন গুলশান থানার তৎকালীন সাব ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) রোমেন মিয়া । তিনি এখন আর গুলশান থানায় কর্মরত নেই। তিনি মাত্র ৬০ দিনের মাথায় তদন্ত শেষ উল্লেখ করে আসামিদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ জানিয়ে গত বছরের ২২ অক্টোবর আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করেন।
কি কারণে ওই মামলা চুড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়া হয়েছিল তা জানতে চাইলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, তিনি ওই সময় দায়িত্বে ছিলেন না। একজন সাব-ইন্সপেক্টরের সহায়তায় তখনকার ফাইলে থাকা তথ্য শেয়ার করে ওসি বলেন, ফাইনাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, মামলার বাদি হাসান মাহমুদ এবং সাক্ষিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। মামলাটি ‘তথ্যগত ভুল’। ফলে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সব আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে ‘চুড়ান্ত রিপোর্ট’ দাখিল করা হলো।
এদিকে, তানভীর আলীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার গুলিবিদ্ধ নাহিদ হাসান ঢাকার সিএমএইচে গত এক বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার শরীরে তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। বর্তমানে আরও একটি অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় আছেন তিনি।
কে এই তানভীর আলী?
একাধিক গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, তানভীর আলীর বিরুদ্ধে বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থ উপার্জন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। ২০১৬ সালে ময়মনসিংহের এক তরুণী তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করে মামলা দায়ের করে। পিটিশন মামলা নং ৭৩/ ২০১৬। সেই সময় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (গুলশান জিআর প্রসেস নং ৪৩২/১৮) জারী করে গুলশান থানার ওসি কে দায়িত্ব দেয়।
২০১৮ সালের ২০ মার্চ সিএমএম কোর্ট ওই পরোয়ানা জারী করে। ভূক্তভোগী ওই নারী অভিযোগ করেন, আসামী তানভীর আলী তাকে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে ফ্লাইটের দিন-তারিখ নির্ধারণ করে তাকে বনানীর একটি বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। তাকে মালয়েশিয়া পাঠানোর বিষয়টি ছিল পুরো ফাঁদ। তার কাছ থেকে তানভীর ৫ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয়। ভূক্তভোগী জানায়, তানভীর নারী পাচার ও অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত। তানভীর কৌশলে ফাঁদ পেতে অনেক তরুণীর সুন্দর জীবন তছনছ করে দিয়েছে। প্রতিবাদ করলে তানভীর তাদের মেরে ফেলা ও সামাজিতভাবে অসম্মান করার ভয় দেখাতো। ওইসব নারী এখন আর এলাকায় থাকে না। পরিবারসহ অনেকেই অন্যত্র চলে গেছে।
এছাড়া, অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন একাধিকবার নোটিশ করলেও তিনি হাজির হননি বলেও জানা গেছে।
মোবাইল ফোনে তানভীর আলীর বক্তব্য নিতে কল করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।