অধ্যাপক বাংলাদেশী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক। তিনি ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক। অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এই পুরস্কার অর্জন করেন।
ড. ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ আরও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী দুলা মিয়া সওদাগর, এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিণী ড. আফরোজী ইউনূস। ব্যক্তিগত জীবনে মুহাম্মদ ইউনূস দুই কন্যার পিতা। মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং ছোট ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একজন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব।
তার প্রথম বিদ্যালয় মহাজন ফকিরের স্কুল। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। কলেজে তিনি নাটকে অভিনয় করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা এবং আজাদী পত্রিকায় কলাম লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি বয়েজ স্কাউটসে যোগ দেন এবং বয়েজ স্কাউটসের পক্ষ থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স-এ যোগ দেন গবেষণা সহকারী হিসেবে। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ইউনূস দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।
১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব বাংলাদেশীদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার জন্য। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক সংহতি দল পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অপরের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অপরের উন্নয়নে সাহায্য করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে গরিবকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের সাথে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্প সহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহকে গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে।

অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে – Banker to the Poor: Micro lending and The battle against World Poverty, Three Farmers of Jobra; Department of Economics, Chittagong University, Building Social Business: The New Kind of Capitalism That Serves Humanity’s Most Pressing Needs (২০১০), এবং A World of Three Zeros: The New Economics of Zero Poverty, Zero Unemployment, and Zero Net Carbon Emissions (২০১৭)।
ড. ইউনূস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৮টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণ করেছেন। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে এই সম্মাননা দেওয়া হয় ইউনূসকে। যিনি এই পদক পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ও মুসলিম।
বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদশালী দুই শতাধিক ব্যক্তির সম্মেলনে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ মে বুধবার জাতিসংঘ ভবনে এ সম্মাননা জানানো হয়। জাতিসংঘে বিশ্বের সম্পদশালী ব্যক্তিদের এ সমাবেশের আয়োজন করে বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন। একজন সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে ইউনূসকে এ আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তার অর্জিত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড, স্বাধীনতা পুরস্কার, আগা খান অ্যাওয়ার্ড, কেয়ার পুরস্কার, মানব হিতৈষী পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, মুহাম্মদ সাহেবুদ্দিন বিজ্ঞান পুরস্কার, শ্রীলঙ্কা, রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এ খান স্মৃতি পদক, বাংলাদেশ, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, পিফার শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণ পদক, বাংলাদেশ, ম্যাক্স সচমিডহেইনি ফাউন্ডেশন ফ্রিডম পুরস্কার, সুইজারল্যান্ড, ঢাকা মেট্রোপলিটন রোটারি ক্লাব ফাউন্ডেশন পুরস্কার, বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক সাইমন বলিভার পুরস্কার, ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিশিষ্ট অ্যালামনাই পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক অ্যাক্টিভিস্ট পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, প্ল্যানেটারি কনশিয়াসনেস বিজনেস ইনোভেশন পুরস্কার, জার্মানি, হেল্প ফর সেলফ হেল্প পুরস্কার, নরওয়ে, শান্তি মানব পুরস্কার- ম্যান ফর পিস অ্যাওয়ার্ড, ইতালি, বিশ্ব ফোরাম পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ব্রডকাস্টিং ট্রাস্ট মিডিয়া পুরস্কার, যুক্তরাজ্য, বিশ্ব দ্যা প্রিন্স অফ অ্যাস্টুরিয়াস অ্যাওয়ার্ড ফর কনকর্ড, স্পেন, সিডনি শান্তি পুরস্কার, অস্ট্রেলিয়া, অ্যাজাকি গাকুডো পুরস্কার, জাপান, ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, ভারত, জাস্টিস অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার, ফ্রান্স, Les Justes D’or, রোটারি অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়ার্ল্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং, যুক্তরাষ্ট্র, গোল্ডেন পেগাসাস অ্যাওয়ার্ড, ইতালি, রোমা অ্যাওয়ার্ড ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান, ইতালি, রাথিন্দ্রা পুরস্কার, ভারত, ওমেগা অ্যাওয়ার্ড অফ এক্সিলেন্স ফর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট, সুইজারল্যান্ড, অ্যাওয়ার্ড অফ দ্য মেডেল অফ দ্য প্রেসিডেন্সি, ইতালি, কিং হুসেইন হিউম্যানিটারিয়ান লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, জর্ডান, আইডিবি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ, আরতুসি পুরস্কার, ইতালি, গ্র্যান্ড প্রাইজ অফ দ্য ফুকুওকা এশিয়ান কালচার পুরস্কার, জাপান, হো চি মিন পুরস্কার, ভিয়েতনাম, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পুরস্কার কাজা ডি গ্রানাডা, স্পেন, নাভারা ইন্টারন্যাশনাল এইড অ্যাওয়ার্ড, স্পেন, মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব টেকনোলজি নেটওয়ার্ক পুরস্কার, যুক্তরাজ্য, ভলভো পরিবেশ পুরস্কার, সুইডেন, জাতীয় মেধা পুরস্কার, কলম্বিয়া, দ্য মেডেল অফ দ্য পেইন্টার অস্কার ওয়াইল্ড, গুয়ায়ামিন পুরস্কার, ফ্রান্স, তেলিছিনকো পুরস্কার, স্পেন, সিটি অফ অরভিয়েটো পুরস্কার, ইতালি, দ্য ইকোনমিস্ট ইনোভেশন পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, লিডারশিপ ইন সোশ্যাল এন্টারপ্রেনার অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, প্রিমিও গ্যালিলেই, স্পেশাল প্রাইজ ফর পিস ইতালি, নিক্কেই এশিয়া পুরস্কার, জাপান, গোল্ডেন ক্রস অফ দ্য সিভিল অর্ডার অফ দ্য সোশ্যাল সলিডারিটি অ্যাওয়ার্ড, স্পেন, ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি গোল্ড মেডেল, বাংলাদেশ, প্রাইজ টু পন্টে, ইতালি, ফাউন্ডেশন অফ জাস্টিস, স্পেন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি নিউস্টাড অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, গ্লোবাল সিটিজেন অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট স্বাধীনতা পুরস্কার, নেদারল্যান্ডস, ইতু বিশ্ব তথ্য সংগঠন পুরস্কার, সুইজারল্যান্ড, সিউল শান্তি পুরস্কার, কোরিয়া, কনভিভেঞ্চিয়া উত্তম সহকারিতা সেউতা পুরস্কার, স্পেন, দুর্যোগ উপশম পুরস্কার, ভারত, সেরা বাঙালী, ভারত, গ্লোবাল ট্রেইলব্লেজার পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, এ বি আই সি সি অ্যাওয়ার্ড ফর লিডারশিপ ইন গ্লোবাল ট্রেড, যুক্তরাষ্ট্র, সামাজিক উদ্যোক্তা পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব উদ্যোক্তা নেতৃত্ব পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, রেড ক্রস স্বর্ণ পদক, স্পেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম শতবার্ষিকী স্মারক, ভারত, ই এফ আর বাণিজ্য সপ্তাহ পুরস্কার, নেদারল্যান্ডস, নিকলস চ্যান্সেলর পদক, যুক্তরাষ্ট্র, ভিশন অ্যাওয়ার্ড, জার্মানি, বাফি গ্লোবাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রুবিন মিউজিয়াম ম্যান্ডেলা অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সাকাল বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব পুরস্কার, ভারত, ১ম আহপাডা গ্লোবাল পুরস্কার, ফিলিপাইন, মেডেল অফ অনার, ব্রাজিল, জাতিসংঘ সাউথ-সাউথ সহযোগিতা পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, প্রোজেক্ট, উদ্যোক্তা পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য মিশন পুরস্কার, নিউইয়র্ক, কিতাকিয়ুশু পরিবেশ পুরস্কার, জাপান, চ্যান্সেলর পদক, যুক্তরাষ্ট্র, প্রেসিডেন্সি পদক, যুক্তরাষ্ট্র, মানব নিরাপত্তা পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, বাৎসরিক উন্নয়ন পুরস্কার, অস্ট্রিয়া, মানবসেবা পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র, শিশু বন্ধু পুরস্কার, স্পেন, এ জি আই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পুরস্কার, জার্মানি, করিনি আন্তর্জাতিক গ্রন্থ পুরস্কার, জার্মানি, টু উইংস প্রাইজ, জার্মানি, বিশ্ব মানবতাবাদী পুরস্কার, ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল অ্যাওয়ার্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, এস্টরিল গ্লোবাল ইস্যু’স ডিসটিংগুইশড বুক প্রাইজ, পর্তুগাল, এইজেনহাওয়ার মেডেল ফর লিডারশিপ অ্যান্ড সার্ভিস, যুক্তরাষ্ট্র, গোল্ডেন বিয়াটেক অ্যাওয়ার্ড, স্লোভাকিয়া, গোল্ড মেডেল অফ অনার অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র, প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম, যুক্তরাষ্ট্র, পি আই সি এম ই টি অ্যাওয়ার্ড, পোর্টল্যান্ড, বৈরুত লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড এবং সোলারওয়ার্ল্ড আইনস্টাইন অ্যাওয়ার্ড।
২০১৬র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষ ধাপে মশাল বহন করেছিলেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি, আইওসির সভায় বক্তব্যও রেখেছিলেন। এরপর ২০২০ টোকিও অলিম্পিক ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হলে ড. ইউনূসকে লরেল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শান্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি দিতে ২০১৬ সালে এই অ্যাওয়ার্ডের প্রবর্তন করা হয়। ড. ইউনূস ছিলেন এই অ্যাওয়ার্ড পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি।
এছাড়া প্যারিস অলিম্পিকে ড. ইউনূসকে আরও বড় সম্মান দেওয়া হয়। বিভিন্ন দিক দিয়েই সেই আসরকে ব্যতিক্রম এবং টেকসই অলিম্পিক গেমস হিসেবে উল্লেখ করেছেন আয়োজকেরা। ড. ইউনূসের তিন শূন্য- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ খ্যাত থিমকেই ওই অলিম্পিকের মূল বার্তা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। প্যারিস ইএসএস-২০২৪ এবং সলিদেও নামের দু’টি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার আদর্শে ইতিহাসের সবচেয়ে টেকসই অলিম্পিক গেমসে পরিণত করার।
এর আগে ২০১৭ সালে প্যারিস অলিম্পিকের মূলমন্ত্র কী হবে- সেটা ঠিক করতে ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানায় অলিম্পিক কমিটি। পরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগোকে নিয়ে গঠিত প্যারিস অলিম্পিক টিমের সদস্য হিসেবে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিন সদস্যের এই দলটি লুজানে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কাছে প্যারিস অলিম্পিকের মূলমন্ত্র উপস্থাপন করেন। এরপরে আসরের সামাজিক ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দলটি জানায়- ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্যারিস অলিম্পিকের মোট উপকরণ সংগ্রহে ৪০০টি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তার পরামর্শ এবং রূপকল্প অনুযায়ীই নির্মাণ করা হয় প্যারিস গেমসের অলিম্পিক ভিলেজ। আসলে অলিম্পিক গেমসের জন্য যে বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়- বেশির ভাগ আয়োজক দেশই গেমস শেষে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু ইউনূসের পরামর্শে প্যারিস ভিলেজ নির্মাণের সময় এমন পরিকল্পনা করা হয়, যাতে অলিম্পিক শেষে এই কাঠামোগুলোকে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ সম্পদের অপচয় হবে না।
১৯৭২ সালে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন ড. ইউনূস। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কারণে দারিদ্র্যের অর্থনৈতিক দিকগুলি অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি সে সময় তার ছাত্রদের ক্ষেতে গিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করতে বলেন। তবে তিনি তখন অনুধাবণ করেন শুধুমাত্র কৃষি প্রশিক্ষণই ভূমিহীন দরিদ্রদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে উপকৃত করবে না। কারণ ভূমিহীন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেয়ে তার অর্থনৈতিক অবস্থাকে পরিবর্তন করা বেশি জরুরী বলে মনে করেন ড. ইউনূস। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, অর্থের অ্যাক্সেস যা তাদের ছোট ব্যবসা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। প্রথাগত মহাজনরা সুদ আদায় করতো তার জাল থেকে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেরিয়ে আসতে পারবে।
১৯৭৬ সালে এই লক্ষ্যে ড. ইউনূস মাইক্রোঋণের একটি প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন। এই ক্রেডিট সিস্টেম যা বাংলাদেশের দারিদ্র্যের সম্মুখীন হওয়া মানুষের চাহিদা মেটাতে ডিজাইন করেন তিনি। ঋণগ্রহীতাদের মাঝে তিনি ২৫ ডলারের মতো ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। আর এই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি ঋণদানকারী গ্রুপকে গুরুত্ব দেন। এতে করে ঋণগ্রহীতার ঋণ ফেরত পাওয়া বিষয়টির নিশ্চয়তাও মেলে। ফলে গ্রুপের সদস্যদের কাছ থেকে সহায়তা সহকর্মী চাপ ছাড়াও ঋণগ্রহীতাদের তাদের ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য করে। বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পকে ১৯৮৩ সালে একটি স্বতন্ত্র ব্যাংকে পরিণত করে। আর এই মডেল পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে মাইক্রোলেন্ডিংয়ের অন্যান্য রূপকে শুধু উৎসাহিতই করেনি তাকে ভিন্ন এক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। যার জন্য তাকে সারাবিশ্বের অন্যতম এক প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ইউনূস মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অন্যান্য বাংলাদেশিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন। তিনি ন্যাশভিলের তার বাড়ি থেকে বাংলাদেশ নিউজলেটারও প্রকাশ করতেন। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্ত হন। তবে কাজটি তার কাছে একঘেয়ে লাগায় তিনি সেখানে ইস্তফা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গ্রামীণ কল্যাণের মাধ্যমে তিনি গড়ে তোলেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন, গ্রামীণ শিক্ষা, গ্রামীণ নিটওয়্যার, গ্রামীণ ব্যবস্থা বিকাশ, গ্রামীণ আইটি পার্ক, গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, গ্রামীণ সলিউশন, গ্রামীণ ড্যানোন ফুডস, গ্রামীণ হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস, গ্রামীণ স্টার এডুকেশন, গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন। অন্যদিকে, গ্রামীণ কল্যাণের আদলে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ফান্ডের মাধ্যমে গঠন করা হয় আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, গ্রামীণ সলিউশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ আইটেক, গ্রামীণ সাইবারনেট, গ্রামীণ নিটওয়্যার, গ্রামীণ আইটি পার্ক, টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড প্রোডাক্ট, গ্লোবাল কিডস ডিজিটাল, গ্রামীণ বায়োটেক, গ্রামীণ সাইবার নেট, গ্রামীণ স্টার এডুকেশন, রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং, গ্রামীণ ইনফরমেশন হাইওয়ে, গ্রামীণ ব্যবস্থা সেবা এবং গ্রামীণ সামগ্রী।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ড. ইউনূস নাগরিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা ঘোষণা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটে চরম অস্থিরতাকালে তার এই ঘোষণা আসে। ড. ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তার আন্দোলন সুশাসন পুনরুদ্ধার এবং দুর্নীতি দূর করতে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু ২০০৭ সালের মে মাসে ড. ইউনূস ওই উদ্যোগ থেকে সরে আসেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬০ বছর বাধ্যতামূলক অবসরের বয়স উল্লেখ করে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে বরখাস্ত করে। ড. ইউনূস এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ শুরু করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের আদালত পরবর্তীতে তার অপসারণ বহাল রাখে।
শ্রম আইনের একাধিক মামলায় তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছিল। ড. ইউনূস এসব মামলাকে হয়রানিমূলক উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এইসাথে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবসময়ই তাকে হয়রানিমূলক মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এসেছে। তিনি কর্তৃত্ব হারান নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের।
২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে এবং ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সে সময়কার সেনাবাহিনী তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়ার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। তবে তিনি তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে কোণঠাসা ছিলেন ড. ইউনূসকে। ওয়ান ইলেভেনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরাতে মাইনাস টু ফর্মুলা বেশ আলোচনায় ছিল। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। মাইনাস টু ফর্মুলার পেছনে অধ্যাপক ইউনূসকে একজন মাস্টারমাইন্ড মনে করতেন শেখ হাসিনা।
পরে ৫ আগস্ট, ২০২৪ এ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। ৬ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ফলে ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় একটি ঘটনার পর সারাদেশে যেখানে বিশাল বিশৃঙ্খলা থাকার কথা- সেখানে সরকার দারুণভাবে সব পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ড. ইউনূস একটার পর একটা সফলতা অর্জন করে চলেছেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে চীন ও ভারত কূটনীতিতেও দারুণ চমক দেখিয়ে এখন সারাদেশের মানুষের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছেন। অনেকের চাওয়া ড. ইউনূস আরও অন্তত চার বছর ক্ষমতায় থাকলে দেশের অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে যাবে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দু-চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি শুধু সামাল দেওয়াই নয়- দারুণভাবে দেশ পরিচালনা করে চলেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।
অনেকেই বলছেন, বরাবরই দেশের গণমানুষের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার বিষয় হয়ে থাকে নিত্যপণ্যমূল্য। অতীতে আমরা দেখেছি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম পরাতে পারেনি কোনো সরকারই। এ কারণে প্রায় সময়ই পত্রিকার পাতা ভরা থাকত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জনগণের নাভিশ্বাস, ক্রেতাদের হাহাকার-এ জাতীয় নানা সংবাদ শিরোনামে। কিন্তু ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৫৪ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সেই পণ্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় লাগাম পরিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে রোজার মাসে সরকার সদাসর্বদা সতর্ক থেকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। রোজায় নিত্যপণ্যের বাজার এর আগে এতটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখেনি কেউ।
কথায় আছে, এ দেশে মানুষের মূল্য কমে, আর জিনিসপত্রের দাম সবসময়ই বাড়ে। গত ১৬ বছর ধরে দ্রব্যমূল্য জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। বেশি দিন না, ছয় মাস আগেও ১৫ টাকা পিস দরে লোকজন ডিম কিনে খেয়েছে। এখন সেই ডিম কেনা যাচ্ছে আট টাকা পিস দরে। মানে দাম প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। এত সস্তায় আমরা ডিম খেতে পারব, সেটা কি ছয় মাস আগেও ভেবেছিলাম আমরা?
এদিকে রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের উৎসবও আরও রঙিন হয়ে ধরা দিয়েছে দেশবাসীর কাছে। এদেশে চিরায়ত চিত্র সড়কে নাড়ীর টানে ঘরে ফেরা যানবাহনের যাত্রীদের ভোগান্তি। এবার সেই দুর্দশার চিত্রও উধাও। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িফেরা মানুষের প্রধান রুট ঢাকা-উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে কোনো যানজট নেই। হাইওয়ে পুলিশ ২৪ ঘণ্টা কঠোর শ্রম দিয়ে মহাসড়ক যানজটমুক্ত রেখেছে। একই দৃশ্য দেখা গেছে অন্যান্য মহাসড়কেও। প্রশাসনের আন্তরিক তদারকির কারণে মহাসড়কে নেই যানবাহনের বাড়তি চাপ, দুই-একটি ঘটনা ছাড়া স্বস্তির ঈদযাত্রা দেখা গেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় বাসস্ট্যান্ডগুলোতে। গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালের যাত্রীদের অনেকে বলছেন- সড়কে যা ঘটেছে, তা বিশ্বাসই হচ্ছে না তাদের। জীবনে এত নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা তারা করতে পারেনি কখনও। ঈদের মধ্যে গত ৪০ বছরেও এমন দৃশ্য দেখেনি দেশের মানুষ।
সড়কের সঙ্গে সঙ্গে রেলেও দেখা গেছে সুশৃঙ্খলা। এতে করে যাত্রীদের মধ্যেও প্রশান্তির ছোঁয়া বিরাজ করছে। নিয়ম করে ঠিক সময়ে ছেড়ে গেছে সব ট্রেন। স্টেশনে নেই কোনো বাড়তি যাত্রীর চাপ। টিকিট কালোবাজারিরা লাপাত্তা। সব মিলিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের টিকিট পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে আগের সেই চিরায়ত হাহাকার কিংবা ক্ষোভ এবার দেখা যায়নি। শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণ বা ঈদে ঘরমুখো মানুষকে স্বস্তি দেওয়াই নয়, প্রবাসী আয় টানতেও গত কয়েক মাসে প্রবাসীদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে এ সরকার। মার্চ মাসের রেমিট্যান্সের দিকে তাকালে এটার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিন বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে এ মাসে।
ঈদ উপলক্ষে রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়তে পারে-এমন ধারণা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু এভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ হাই জাম্প দিয়ে আকাশে উঠে যাবে- এমনটা ভাবতেও পারেনি কেউ। ধুঁকতে থাকা নাজুক ব্যাংকগুলোকেও সরকার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বুক উঁচু করে। সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের স্বার্থ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে বলে জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এসব ব্যাংকের আমানতকারীদের পাশে সরকার আছে। ব্যাংকগুলোর অবস্থা উন্নয়নে এগুলোর পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এরপরই আস্থা ফেরে ব্যাংকগুলোতে।
ব্যাংক খাত থেকে গত ১৭ বছরে বিভিন্নভাবে বড় ধরনের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। মূলত সাত আটটি ব্যাংক থেকেই এই অর্থ বের হয়ে গেছে। ফলে এসব ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছিল। সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে দেয়নি। টাকা ছাপিয়ে দিলে তাতে করে দুই লাখ কোটি টাকা ছাপাতে হতো। এতে মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যেত। এর বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে সীমিত আকারে টাকা দিয়েছে। এসব ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত হিসেবে পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে টাকার নিশ্চয়তা। এভাবেই ব্যাংক খাতের বড় রকমের ঝুঁকি কাটিয়ে তুলেছে ইউনূস সরকার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, একটা দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা। সেই হিসাবে ড. ইউনূসের প্রতি জনগণের আস্থাটা যে দিনকে দিন বাড়ছ- সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এর প্রমাণও মিলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিডে লাখো মানুষ ড. ইউনূসের দেশ পরিচালনার প্রশংসা করছেন। অনেকে লিখছেন- এই সরকারকে আরও অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখা দরকার। কেউ কেউ লিখছেন- অন্তত দশ বছরের আগে ড. ইউনূস যেন দায়িত্ব না ছাড়েন। দেশের প্রধান প্রধান খাতের আমূল সংস্কার করার পরই যেন তিনি নির্বাচন দেন। কারণ, অতীতের কোনো সরকারই কথা রাখেনি। এবার রাষ্ট্র সংস্কারের এই সুযোগ ছাড়া যাবে না।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ড. ইউনূস প্রসঙ্গে লিখছেন, এই লোক রোজায় দ্রব্যমূল্য ঠিক রেখেছে। সারা বছর যেখানে এই সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে। সেখানে উনি থাকায় বরং দ্রব্যমূল্য আশাতীত ভাবে কমেছে। ঈদের আগের চারদিন বাড়ি ফেরে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। মানে প্রতিদিন ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু এবার কোথাও নেই ভোগান্তি, নেই ট্রেন-বাস-লঞ্চের কোন শিডিউল বিপর্যয়। এই ইয়াং হার্টের মানুষটা বেঁচে থাকুক অনেকদিন । তার ক্ষমতায় থাকতে পারাটাই যে দেশের জন্য এক সংস্কার।
ইউনূস সরকারের ছয় মাসের অন্যতম বড় সাফল্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সরকার তার নীতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে। যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার নতুন সিদ্ধান্ত এসছে। ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রথম ধাপে ফিরিয়ে নিতে সম্মতি দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। কূটনীতিকদের মতে- বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে ইউনূস সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে। যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে।
বিশেষ করে ভারতকে পাশ কাটিয়ে তিনি চীনে যাওয়ার পর চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীনা বিনিয়োগ নিয়ে যে চমক দেখিয়েছেন-তাতে ভারত সরকারের মাথা খারাপ হওয়ার দশা। সে কারণেই সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ড. ইউনূসের সাথে ৪০ মিনিট দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন, ইউনূস মোদি বৈঠকে হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতেও মোদিকে নমনীয় দেখা গেছে। তার আচরণে মনে হয়েছে তিনি স্বৈরাচারি হাসিনাকে ফেরত পাঠাবেন। আগামীতে তার বিচার এদেশের মাটিতেই হবে। এটাকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়। যে বিজয়ের নায়ক ড. ইউনূস নিজেই। আমেরিকার অতিরিক্ত শুল্কারোপের বিষয়েও ড. ইউনূসের কৌশল একটা পজিটিভ ফলাফল বয়ে আনবে বলে অনেকেরই ধারণা। ইতোমধ্যে তিনি এ সংক্রান্ত বিষয় আলোচনার জন্য জরুরি মিটিং ডেকেছেন। অনেকের মতে, ড. ইউনূস চাইলে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বিশ্লেষকদের মতে, ড. ইউনূস ধীরে ধীরে স্টেটসম্যান হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন। তার চলার গতি ধীর এবং মাপা। তবে তার গন্তব্য এক প্রকার নিশ্চিত। ড. ইউনূস এমন এক অবস্থায় আছেন- তার আর পাওয়ার বা চাওয়ার কিছু নেই। দুনিয়ার তাবৎ সম্মানের যা যা পাওয়া সম্ভব-সেসবের সবগুলোই তিনি ইতোমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন- যা অতীতের কোনো সরকারই পারেনি।