১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা মাতৃভাষা ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দলোনের মাধ্যমে বাঙালিরা পায় মক্তির সনদ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবাত্মক রূপ পাওয়া বাঙালিদের চেতনা। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ৭৫’র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট সবকিছুই যেন ফুটে উঠেছে রাজশাহী কলেজের একটি টেরাকোটায়। এই টেরাকোটায় যেন একটি উদয়াস্তে বাংলাদেশ।
রাজশাহী কলেজ কলাভবনের ঠিক পশ্চিম পাশে অবস্থিত উদয়াস্ত এই টেরাকোটা। তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাস পৌঁছে দিতে দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজে নির্মিত হয়েছে এমনই এক মনকাড়া ও অপূর্ব টেরাকোটা। এতে ফুটে উঠেছে দেশের সুবিশাল সংগ্রামের ইতিহাসের শৈল্পিক অবয়ব। এই টেরাকোটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাস। কলেজের এই টেরাকোটার লে আউট ও ডিজাইন করেন প্রকৌশলী মো. নাইমুল হাসান।
প্রাচীন বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল এই টেরাকোটা। উত্তরের জেলা বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসিজদসহ প্রত্নতাত্ত্বিক নানা স্থানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানা আকার, আকৃতি ও নকশার হাজার বছরের পুরনো টেরাকোটা।
রাজশাহী কলেজের এই টেরাকোটা দেখতে গিয়ে দেখা যায়, টেরাকোটায় তুলে ধরা হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ৭৫’র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট সবকিছুই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও সর্বস্বত্যাগী সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের তেজোদীপ্ত ভাষণের কারুকার্য খচিত ফলক। তার পাশেই উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। রয়েছে রাইফেল হাতে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নজরকাড়া বিপ্লবী ভঙ্গিমা। এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের সময়ের সুচারু অবয়ব। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে বীর সৈনিক বিজয়ীর বেশে নির্ভীক প্রহরীর মতো স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। টেরাকোটার চিত্রপটে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর শহীদদের আত্মত্যাগ, দুঃখ ও শোকের প্রতীক দৃশ্যমান। যা প্রতিক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলার স্বাধীনতার গৌরবময় স্মৃতির কথা। এ শিল্পকর্মটি দেখতে প্রতিদিন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কৌতুলহী সাধারণ মানুষ আর দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই আছে।
কলেজের ডিগ্রি পাস কোর্সের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিরুল ইসলাম বলেন, কলেজে কলা ভবনের সামনে অভিনব কৌশলে একটি সুন্দর স্থাপনা করা হয়েছে। আমরা ঘুরতে এসে এই টেরাকোটা স্থাপনার মাধ্যমে দেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারি। ওই সময়কার সকল আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারি। টেরাকোটার পাশে বিস্তারিত লেখাগুলো আমাদের জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
সংস্কৃতি বিভাগের ২বর্ষ শিক্ষার্থী নুর হোসেন বলেন, এই টেরাকোটায় ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই টেরাকোটাগুলো এখানে আসার আগে আমরা অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখতে পায়নি। এগুলো থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।
কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. শিখা সরকার বলেন, রাজশাহী কলেজের স্বাধীনতা চত্বরের দেয়ালে টেরাকোটার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে। এই টেরাকোটা বাঙালি জাতির ঐতিহ্য বহন করে। এই স্থাপত্য আমাদের সংস্কৃতি ইতিহাস বহন করে।
রাজশাহী কলেজ সূত্রে জানা যায়, নির্মিত টেরাকোটার দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট ও প্রস্থ ৫ ফুট। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘উদয়-অস্ত বাংলাদেশের’। শিল্পী সৈয়দ মামুন-অর-রশিদ টেরাকোটার কাজটি করছেন। এতে ব্যয় হচ্ছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। অসাধারণ এই কাজের মাধ্যমে উঠে এসেছে বাংলাদেশের বিবর্তন ও পরিবর্তনের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে স্থাপনাটি এক অনন্য নিদর্শন।
রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, এই টেরাকোটায় রয়েছে পরাধীনতার শেকল থেকে বাঙালির মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের সংগ্রামী পথের নিশানা। প্রতিফলিত হচ্ছে স্বপ্ন, বেদনা ও গৌরব। জাগ্রত করছে চেতনাবোধ। কোনোটা বড় আকারের মুখোশ, কোনোটা নারীর গড়ন। বড় পরিসরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবয়বও দারুণ নান্দনিক। শির উঁচু করে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে এক যোদ্ধা। এক প্রান্তে জাতীয় চার নেতার অবয়ব। শিল্পীর শৈল্পিক ছোঁয়ায় টেরাকোটার ফ্রেমে ধারাবাহিকভাবে ধরা দিয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড দৃশ্যপট। যা দেখে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের ইতিহাসকে বুকের ভেতর লালন করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, টেরাকোটা ইতিহাস সংরক্ষণের একটি মাধ্যম। এখানে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে । কোন ঘটনা শুনলে বা পড়লে ভালোভাবে মনে থাকে না কিন্তু বাস্তবে দেখলে সেটা ভালো মনে থাকে। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও চার নেতাকে তুলে ধরা হয়েছে। টেরাকোটা বাঙালির সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।
উদয়াস্ত টেরাকোটার পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। টেরাকোটা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে আমাদের এই প্রচেষ্টা। আগামী সপ্তাহের মধ্যে পুরো কাজটি সম্পন্ন হবে। এরপর এটির বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন করা হবে। এমন স্থাপত্যের মাধ্যমে শুধু কলেজের শিক্ষার্থীরাই নয়, দর্শনার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং পূর্ববর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে জানতে পারছে। বুকে ধারণ করছে দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা।
পদ্মাপাড়ের এই শহরে ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজ বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ৬৮৫টি কলেজের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি তিনবার দেশসেরা কলেজের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে এই কলেজেই সর্বপ্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া শুরু হয়। এটি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি দেয়। ১৯৯৬ সাল থেকে এই কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ছাত্র নথিভুক্ত করা বন্ধ করা হলেও ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে পুনরায় ভর্তি করা হচ্ছে।
ড. কুদরত-ই-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কাজী মোতাহার হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ঋত্বিক ঘটক, আনোয়ার পাশা, ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াসহ অসংখ্য গুণী ব্যক্তি এই রাজশাহী কলেজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।