জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া ওই আন্দোলনেই টানা ১৫ বছরের বেশি সময় শাসন করা কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শুরুতে আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আন্দোলনে রক্তপাত শুরু হওয়ার ২০ দিনের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩৬ দিনের আন্দোলনে হাজারের বেশি শহীদ হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা আহত হন।
সেই সময় অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার সাহসের কাছে পরাজয় হয় শেখ হাসিনা সরকারের। কেমন ছিল ঐতিহাসিক এ আন্দোলনের ঘটনাবহুল ৩৬ দিন যা দেশের পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
আন্দোলনের সূত্রপাত ২০২৪ সালের ৫ জুন কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পরপরই। ১ জুলাই কোটা বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এ দিন তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষার্থীরা ২ থেকে ৬ জুলাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের পাশাপশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। যার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’।
৭ থেকে ৯ জুলাই সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে ব্যাপক বিক্ষোভ-অবরোধে অচল হয়ে যায় রাজধানী। ১০ জুলাই সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। পরের দিন ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সম্পূর্ণ বেআইনি উল্লেখ করেন। শাহবাগ মোড় অবরোধের পাশাপাশি ১২ জুলাই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
কোটা যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ১৩ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন; অতপর রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভ। মধ্য রাতে শিক্ষার্থীরা মিছিলে নামেন।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা করে ছাত্রলীগ। নিরীহ ছাত্রীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সাধারণ মানুষ।

পরের দিন ১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। একই সাথে এইদিন চট্টগ্রামে ওয়াসিম নিহতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়।
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদদের গায়েবানা জানাজায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা করে। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন শেখ হাসিনা; ওই রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেসবুক। ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশজুড়ে প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে। আলোচনায় বসতে সরকার রাজি হলেও অনেক মানুষের প্রাণহানীর প্রেক্ষাপটে প্রস্তাব নাকচ করে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
১৯ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীতে ব্যাপক সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট সেবা। ২০ জুলাই ৩৮ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ আসে; হেলিকাপ্টার থেকেও গুলি চালানো হয় ছাত্র জনতার ওপর।
২১ থেকে ২৫ জুলাই সারা দেশে ছাত্র জনতার সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর মাঝেই নিখোঁজ থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়।
২৫ জুলাই শেখ হাসিনার বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করে বিটিভি ভবনে গিয়ে শেখ কান্নার বিষয়টির প্রতিবাদ জানান অনেকে। ডিবির হেফাজতে থাকা ছয়জন সমন্বয়ক ২৮ জুলাই ভিডিও বার্তায় কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছাত্র-জনতার মৃত্যুতে সরকার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে ছাত্র-জনতা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি ঘোষণা কর। এর মধ্যেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত আর রক্তপাত হয়। কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার।
২ আগস্ট রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পী সমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ।
৩ আগস্ট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক, অভিভাবক, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে অংশ নেন। এদিন বিকেলে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন। এতে জনসমুদ্রে রূপ নেয় শহিদ মিনার এলাকা। সেই জমায়েত থেকে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম।
৪ আগস্ট সরকার পতনের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এ পর্যায়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে সে সময়ের সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাতে ঘোষণা দেয়, ৬ আগস্ট নয়, ৫ আগস্টেই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি হবে।
৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালন হয়। সকাল ১০টার পর থেকেই উত্তরা এবং যাত্রবাড়ী দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে হাজারো মানুষ। দুপুর নাগাদ শেখ হাসিনার পতনের কথা শোনা যায়। দুপুরের পর রাজপথগুলো গণজোয়ারে পরিণত হয়। এর মধ্যেই খবর আসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। রাজপথে শুরু হয় বিজয় উল্লাস, ভিড় জমে মিষ্টির দোকানে। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে বিজয়ী ছাত্র-জনতা। অবসান হয় ফ্যাসিবাদের।