হত্যার পর কতগুলো লাশ একটি রিক্সা ভ্যানে চ্যাংদোলা করে তুলে স্তুপ করা হয়। এরপর রিক্সা ভ্যান থেকে একটি পুলিশ ভ্যানে লাশগুলোকে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আগুনের তীব্রতা বাড়াতে লাশের মধ্যে কাঠের বেঞ্চ নিক্ষেপ করে পুলিশ।
সোমবার (১৮ আগস্ট) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের সময় বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আশুলিয়া ছয়জনের লাশ পোড়ানোর এই অমানবিক ভিডিও দৃশ্য ফুটে ওঠে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের স্ক্রিনে প্রদর্শিত ভয়াবহ ওই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদেন সাক্ষী দিতে আসা শহীদ আস-সাবুরের পিতা মো: এনাব নাজেজ জাকি। পুড়িয়ে ফেলার আগে গুলিবিদ্ধ ছেলের রক্তাক্ত চেহারা দেখিয়ে অশ্রুসিক্ত এই পিতা বলেন, ‘ঐ যে আমার ছেলে, ওই যে আমার ছেলে।’ এসময় ট্রাইব্যুনালে বাকরুদ্ধ নিরবতা নেমে আসে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়া শহীদ আস-সাবুরের পিতা আজ সাক্ষীর জবানবন্দিতে বলেন, আমার ছেলেকে গত বছর ৫ই আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপরে তাকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার ছেলের পরিধেয় টি-শার্টের পোড়া অংশ এবং তার পোড়া শরীরের সাথে থাকা মোবাইল থেকে সিম বের করে অন্য একটি মোবাইলে সংযুক্ত করে লাশ সনাক্ত করা হয়। এই সংক্রান্তে দুটি ভিডিও আমার কাছে আছে। (ভিডিও সম্বলিত একটি পেনড্রাইভ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন)। একপর্যায়ে এই ভিডিও দুটি আজ ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়।
ছেলে হত্যার সাক্ষ্য দিয়ে শহীদ আস-সাবুরের পিতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং সাবেক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উস্কানিতে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে, সেসময়কার আশুলিয়া থানার ওসি, এসআই, কনস্টেবল এরা আমার ছেলেকে হত্যা করে।
‘এছাড়া ঢাকা উত্তরের উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ হেল কাফি, ডিবির এসআই আরাফাত হোসেন, ঢাকা ১৯ এর সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামদের সহায়তায় ও মদদে পুলিশ এই হত্যাকান্ড চালায়। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি চাই। যেভাবে আসামিরা আমার ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, আমি সে ধরণের শাস্তি চাই।’
আজকে পর্যন্ত এই মামলায় ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।
আগামী বুধবার (২০ আগস্ট) পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১।
আজ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম এবং গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করেন।
এসময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে জেরা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
আর এই মামলায় গ্রেফতারের পর রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে।
অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে।
দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।