চীন সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী

চীন সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী

চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসে ১৩ জন নিহতের ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম ‘কালো অধ্যায়’ হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন আদালত।

বুধবার (১০ জুলাই) এক যুগ আগে দায়ের হওয়া মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞা এসব মন্তব্য করেছেন। রায়ে ৮ আসামির প্রত্যেককে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসাথে তাদের প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

আলাদতের রায়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে মানুষের মৃত্যু ও আহতের ঘটনা ফৌজদারি মামলার মতো ঘটনা প্রমাণের কোনো আবশ্যকতা নেই। ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেভাবে প্রমাণিত। এতো বিশাল আকারের কর্মযজ্ঞের মধ্যে তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৩ জন মানুষ মারা যাওয়া ও বহু মানুষ আহত হওয়ার এই ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। মামলায় নিহতের ক্ষেত্রে আসামিদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মৃত্যু হতে পারে এমন ধারণাও আসামিদের ছিল না। প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য, তদন্ত কমিটিসমূহের প্রতিবেদন ও নথিতে রক্ষিত কাগজে এতো বড় দুর্ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দায় প্রায় পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার-পারিশার। কিন্তু প্রতিষ্ঠান একটি বিমূর্ত ধারণা মাত্র। প্রতিষ্ঠানকে সাজা প্রদান করা বাস্তবসম্মত নয়। বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত এই দুর্ঘটনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মালিক থেকে শুরু করে সকল কর্মচারী, যারা যেই পদেই থাকুক না কেন।

‘এই আসামিরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংঘটিত যে কোনো অপরাধমূলক অবহেলার জন্য দায়ী। এই দায় আসামির ব্যক্তিগত নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক দায়। প্রতিষ্ঠানের সাজা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছতা ও জন্যবদিহিতা হুমকির মুখে পড়বে। একইসঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার এই নিম্ন বিত্ত মানুষগুলোর পারিবারের অভিশাপ থেকে এ দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের জবাবদিহিতার অভাব, নির্মাণকারী, ঠিকাদার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে কাজের সমন্বয় না থাকা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো এতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ন্যূনতম নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, দুর্ঘটনার পর ফ্লাইওভার নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের পারস্পরিক দোষারোপ ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি উদবুদ্ধ যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে।’

চীন সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী
তৎকালীন পত্রিকায় ছাপানো খবর। ছবি: সংগৃহীত


রায়ে বিচারক আরও উল্লেখ করেন, এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃতদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত শ্রেণির এবং এদের অনেকেই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। ২টি তদন্ত কমিটি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার ও পারিশার ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে বহু অনিয়ম ও ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছেন, যার দায় আসামিরা উক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

রায়ে বলা করা হয়, একজন ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে এটা প্রমাণিত যে, দুর্ঘটনা সংঘটনের পর সিডিএ কর্তৃপক্ষ ভুক্তভোগীদের ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছেন। যা ঘটনার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে এ আদালত মনে করে। কোনো প্রাণের ক্ষতিপূরণ অর্থ দ্বারা পূরণ হওয়ার নয়। কারণ এ ঘটনায় মৃত এবং আহত ব্যক্তিদের পরিবার নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘদিন একটি মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা অর্থ দিয়ে পূরণযোগ্য নয়। তাছাড়া, ভুক্তভোগীদের অনেকেই শারীরিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়ায় জীবিকা অর্জনে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪৫(১) (বি) ধারার বিধান মোতাবেক, দেওয়ানি আদালতের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রেখে, আসামিদের প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকা করে জরিমানা ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারকে, যার মধ্যে মৃতের পরিবারসমূহকে ১ লাখ টাকা হারে এবং আহতদের পরিবারকে অবশিষ্ট টাকা আনুপাতিক হারে, প্রদান করলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে বলে এ আদালত মনে করে।

পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, আসামিপক্ষের দেওয়া সংশ্লিষ্ট পত্রিকার কপিদৃষ্টে দেখা যায়, দুর্ঘটনার পর সিডিএর চেয়ারম্যান মৃতের পরিবারকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা, পঙ্গুদের ১ লাখ টাকা এ আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। কিন্তু, আসামিপক্ষে দেওয়া পত্রিকার কপি একটি ফটোকপিমাত্র, যার মূলকপি চিহ্নিত হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, আর্থিক অনুদানপ্রাপ্ত এমন কোনো মৃতের পরিবারের সদস্য কিংবা গুরুতর আহত কাউকে আসামিপক্ষ হতে ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। মামলাটি দীর্ঘ ১২ বছরের পুরাতন একটি মামলা এবং আসামিরাসহ ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর পরিবার, সাক্ষীরা দীর্ঘদিন যাবৎ ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশায় কোর্টে আসা যাওয়া করছে। ক্ষতিগ্রস্তের দ্রুত বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত না করা এটা রাষ্ট্র এবং বিচারকার্যে জড়িত সকলের ব্যর্থতা।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ বলেন, পেনাল কোডের ৩০৪ এর এ ৩৪ ধারায় অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামি ৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও অনাদায়ে আরও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পেনাল কোডের ৩৩৮ এর ৩৪ ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। উভয় কারাদণ্ড একটির পর আরেকটি চলবে। রায়ের সময় আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, আসামিদের প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকা জরিমানার টাকা নিহত পরিবারের কাছে ১ লাখ টাকা এবং আহতদের পরিবারকে অবশিষ্ট টাকা আনুপাতিক হারে প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আসামিদের উপর আরোপিত জরিমানার অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করা হবে। সেইসঙ্গে আসামিদের উপর আরোপিত জরিমানার অর্থ এজাহারে উল্লেখিত নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারসমূহের নিকট রায়ে উল্লেখিত হারে হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আটজন সবাই ঠিকাদার মীর আখতার-পারিসা’র (জেভি) তৎকালীন কর্মী। তারা হলেন- প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, মনজুরুল ইসলাম, প্রকৌশলী আবদুল জলিল, আমিনুর রহমান, আবদুল হাই, মোশাররফ হোসেন, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজাহান আলী ও রফিকুল ইসলাম।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট আবদুর রশীদ বলেন, এই দুর্ঘটনার দায় প্রতিষ্ঠান এড়াতে পারে না। আদালত রায় ঘোষণার সময় এই মেসেজটাই দিয়েছেন, আসামিরা যেখানেই দায়িত্ব পালন করুক না কেন এ দায় তাদের ওপরও বর্তায়। সারাদেশে আরও যেসকল প্রতিষ্ঠান এরকম বড় বড় কাজ করছেন তারা যেন সতর্ক থাকেন এবং এরকম দুর্ঘটনা না হয় সেই মেসেজই দিয়েছেন আদালত।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, কর্তব্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে প্রাণহানির ঘটনায় প্রকল্প পরিচালক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর আদালতে ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৮ জুন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ এসএম মজিবুর রহমানের আদালত ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

Scroll to Top