<![CDATA[
চীনে বিক্ষোভের মুখে গত ডিসেম্বরে ‘জিরো কোভিড’ নীতি বাতিল করা হয়। এরপর হঠাৎ করেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। সেই থেকে প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চীনের করোনা পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হাসপাতালগুলোতেও রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায় সম্প্রতি চীন সরকারের প্রকাশ করা কোভিডে মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকেও।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে বিশ্বের প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনাটিও ঘটেছিল চীনে। এরপর দ্রুতগতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। ২০২০ সালের ১১ মার্চ করোনাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
মহামারির প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দেশজুড়ে যাবতীয় কঠোর করোনাবিধি জারি রেখেছিল চীন। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশটির এ অবস্থান পরিচিতি পেয়েছিল ‘জিরো কোভিড’ নীতি হিসেবে। তার সুফলও অবশ্য পেয়েছিল দেশটি।
মহামারির দুই বছরে যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত ও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে-সেখানে চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই সময়সীমার মধ্যে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ৩৩ হাজারের কিছু বেশি এবং মৃত্যু ছিল এক হাজারের কিছু ওপরে।
তিন বছর কঠোর করোনাবিধির মধ্যে থাকার জেরে অতিষ্ঠ চীনের সাধারণ জনগণ গত নভেম্বরের শেষদিকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে ৭ ডিসেম্বর সেই ‘শূন্য কোভিড’ নীতি থেকে সরে আসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রশাসন।
এরপর দেশটিতে আবারও ভাইরাসটির ব্যাপক প্রকোপ শুরু হয়। প্রকোপ বাড়তে থাকায় দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। শুধু তাই নয়, শেষকৃত্যানুষ্ঠান স্থলে তৈরি হয় লাশের দীর্ঘ সারি।
এদিকে গত ৩১ ডিসেম্বর নতুন বছর উপলক্ষে এক শুভেচ্ছা ভাষণে জনগণকে ধৈর্য্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রত্যেকেই দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করছে, আমাদের ঠিক সামনেই অপেক্ষা করছে আশার আলো।’
আরও পড়ুন: বিনিয়োগ নিরাপত্তা নিয়ে চীনের উদ্বেগ
তিনি আরও বলেন, ‘চীন কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারাত্মক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি ও সময়ের প্রয়োজনে করোনার বিধিনিষেধ পরিবর্তন করা হয়েছে। আমাদের এখনও লড়াই করতে হচ্ছে।’
শি জিনপিং আরও বলেন, ‘সবাই অত্যন্ত সংযম সাধন করছে এবং কঠোর পরিশ্রম করছে। আমাদের সামনে নতুন সকাল। চলুন, সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কঠোর পরিশ্রম করি। অধ্যবসায় মানেই সফলতা, ঐক্য মানেই সফলতা।’
এর আগে গত ৩০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত শিন গ্যাংকে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন শি জিনপিং। গ্যাংয়ের কূটনৈতিক ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ব্রিটেনের চীনা দূতাবাসেও। এমনকি তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শি জিনপিংয়ের চিফ প্রটোকল অফিসার হিসেবেও কাজ করেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জিরো কোভিড নীতি চীনের জনগণকে ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিলেও দেশটি বিশ্ব থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিল। এছাড়া গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে তাদের কূটনৈতক সম্পর্ক বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগের মাধ্যমে চীনের প্রেসিডেন্ট বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষতি মেরামত করতে আগ্রহী হবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত ৮ জানুয়ারি (রোববার) চীন করোনা ব্যবস্থাপনাকে ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে নামিয়ে ‘বি’ ক্যাটাগরি করা হয় ও সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। পরদিন সোমবার (৯ জানুয়ারি) থেকে করোনা সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার।
আরও পড়ুন: চীনে এক সপ্তাহে ১৩ হাজার করোনা রোগীর মৃত্যু
তবে বিতর্কিত কোভিড নীতি বাতিলের এক মাসেরও বেশি সময় পর শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন (এনএইচসি) প্রথমবারের মতো করোনায় প্রাণহানির তথ্য প্রকাশ করে।
কমিশনের চিকিৎসাবিষয়ক বিভাগের পরিচালক জিয়াও ইয়াহুই বলেছেন, গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনে অন্তত ৬০ হাজার মানুষ করোনায় মারা গেছেন। তিনি জানান, মেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলো গত এক মাসের কিছু বেশি সময়ে কোভিড সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৫০৩ জনের প্রাণহানির তথ্য রেকর্ড করেছে।
জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য মতে, যারা মারা গেছেন তাদের গড় বয়স ৮০ দশমিক ৩ বছর। যাদের প্রাণহানি ঘটেছে তাদের ৯০ শতাংশের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি।
নতুন করে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়ায় ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের বেশ কিছু দেশ চীন থেকে আসা ভ্রমণকারীদের ক্ষেত্রে অন্তত ৩২ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে এসব নিষেধাজ্ঞাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছে চীন সরকার।
এমনকি বেশ কিছু দেশের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপে নিয়েছে বেইজিং। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোই শুধু চীনের ওপর এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এর মধ্যে ভারত, ঘানা, কাতার এবং কোস্টারিকার মতো কিছু দেশও রয়েছে।
বিশ্বের যেসব দেশ থেকে সবচয়ে বেশি বিদেশগামী ফ্লাইট চলাচল করে, চীন সেসব দেশের অন্যতম। মহামারি সংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ারর পর চীন থেকে বিদেশগামী যাত্রীবাহী ফ্লাইট ধীরে ধীরে বাড়ার ফলে, বিদেশগামী চীনা পর্যটকের সংখ্যাও বাড়ছে।
অনেক দেশ, দীর্ঘ তিন বছরের বিরতির পর চীনা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। ফলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিরোধ খুব শিগগিরই কেটে যেতে পারে। তবে চীন যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আবার দীর্ঘায়িতও হতে পারে।
আরও পড়ুন: চীনে ৮০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত
সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোভিড-১৯ ভাইরাসের সবশেষ ভ্যারিয়েন্ট এক্সবিবি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ বিষয়ক নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির তথ্য প্রকাশ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এর আগে চীনে কোভিড পরস্থিতি ভয়ানক আকার ধারন করায় দেশটির নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। তার জবাবে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন দেশ দুটির নাগরিকদের স্বল্পমেয়াদী ভিসা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
কোভিডের তথ্য শেয়ার নিয়ে চীনের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। যেমনটি তারা করেছিল করোনা মহামরির শুরুর দিকে। চীন সরকার তখন করোনার প্রাসঙ্গিক তথ্য শেয়ার করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন করোনা মোকাবিলায় সাফল্যের কথা তুলে ধরলেও তার এই অবস্থানকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উপায় বলেই অনেকে মনে করছেন। কারণ এখন যখন আবার দেশটিতে করোনার নতুন ঢেউ দেখা যাচ্ছে, ঠিক একই সময়ে করোনার সঠিক তথ্য দেশটির সরকার নানাভাবে চাপা দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে। তাইওয়ান পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ, যা তাইওয়ান প্রণালীর পূর্বে চীনা মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। অবশ্য তাইওয়ানকে বরাবরই নিজেদের একটি প্রদেশ বলে মনে করে থাকে বেইজিং।
২০২২ সালের অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, মূল ভূখণ্ডের সাথে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণ অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। এজন্য সামরিক পথে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিও খোলা রেখেছে বেইজিং। অন্যদিকে চীনের প্রদেশ নয়, বরং নিজেকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে মনে করে থাকে তাইওয়ান।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক রায়ান হাসের মতে, চীনা প্রেসিডেন্ট হয়তো মাও সেতুংয়ের ‘যুদ্ধ, আলাপ-আলোচনা’ এই কৌশল অনুসরণ করছেন। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভাইরাস নজরদারির মতো পারস্পরিক উদ্বেগের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারেন।
তবে আগামী ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে করোনার তথ্য শেয়ার, ভ্রমণ বিধিনিষেধ নিয়ে যেকোনো উদ্যোগ বাইডেনের জন্য কঠিন হতে পারে।
আরও পড়ুন: চীন-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কের গভীরতা বাড়ছে যেভাবে
এছাড়া ইউরোপীয় সরকারগুলো সম্ভবত ২০২০ সালের তুলনায় চীনের কোভিডের বিষয়ে কম কথা বলবে। তবে এর বিপরীতও হতে পারে যদি চীনের বর্তমান পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হয় এবং ইউরোপে করোনা ছড়িয়ে পড়ে। অথবা চীন ইউরোপীয় দেশগুলোতে নতুন করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে।
কোভিড নিয়ে নতুন যেকোনো উত্তেজনা চীনের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। কারণ গত নভেম্বরে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলজ ও সবশেষ জানুয়ারির শুরুতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বেইজিং সফর করেছেন। তারা উভয়ই চীনের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ার অঙ্গীকার করেছেন।
চীনে সম্ভাব্য বিপর্যয়ে শি জিনপিং সরকার কূটনৈতিকভাবে অনেক দেশকেই পাশে পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব দেশ চীনা ভ্যাকসিন পেয়েছে। ৬ জানুয়ারি বেইজিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের এক ব্রিফিংয়ে ইকুয়েডর, মাদাগাস্কার, মঙ্গোলিয়া এবং আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূতরা চীনের কোভিড প্রতিক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন।
এছাড়া আফ্রিকার অনেক দেশও আন্তর্জাতিক নানান ইস্যুতে চীনের পাশে থাকবে বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিন গ্যাং দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরেই আফ্রিকা গিয়েছেন। চীন ও আফ্রিকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তিনি ইথিওপিয়া, গ্যাবন, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন এবং মিশর সফর করেছেন।
বৈশ্বিক নানা উদ্বেগের মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে পরবর্তী সম্ভাব্য মহামারির প্রস্তুতি। চীনের বিশাল জনসংখ্যা, বন্যপ্রাণী বাণিজ্যসহ নানান ইস্যুতে এই ধরনের প্রস্তুতি খুবই অপরিহার্য।
]]>