‘চিৎকার করে বললাম, আমার ছেলের ভবনে আগুন’

‘চিৎকার করে বললাম, আমার ছেলের ভবনে আগুন’

মাইলস্টোন কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে শোকের মাতম। সন্তানের জন্য মা-বাবার করুণ চিৎকার তুলে ধরেছে এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রকৃত চিত্র। কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক তাসলিমা আকতারও নিজের সন্তানকে বাঁচাতে ধাক্কাধাক্কি, দৌড়ঝাঁপ, কান্না আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে গেছেন।

তাসলিমা আকতার এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে জানান, ২১ জুলাই দুপুর ১টা ১১ মিনিটে ছেলের ফর্ম মাস্টার বাবুল স্যার ফোন করে জানান, আজ ছুটি হবে ১টা ৪০ মিনিটে। তিনি তখন কলেজের টিচার্স রুমে অবস্থান করছিলেন। কথা শেষ করে ফোন রেখে দিতেই বিকট বিস্ফোরণ। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন আগুনের শিখায় জ্বলছে ছেলের ভবন।

‘আমি চিৎকার করে বললাম— আমার ছেলের ভবনে তো আগুন লাগছে,’ জানান তাসলিমা ম্যাডাম। সেই মুহূর্তে তার পাশে ছিলেন সহকর্মী এজাজ মাসুদ স্যার। তিনিও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। আমি চিৎকার করে দৌড়াচ্ছি স্যার আমাকে বলছেন ‘দোয়া করেন আল্লাহকে ডাকেন’।

সেকেন্ডের ব্যবধানে দৌড়ে পৌঁছান দুর্ঘটনাস্থলে। চোখের সামনে তিনটি গলিত দেহ, পুড়ে যাওয়া শরীর, আর ছেলের ভবন থেকে বেরুতে না পারা শিক্ষার্থীদের আহাজারি— সব মিলিয়ে যেন এক বিভীষিকাময় দৃশ্য। সামনে গিয়ে দেখি যেই ভবনে আমার ছেলে ক্লাস করে; যেই রুমে আমার ছেলে ক্লাস করে, সেই রুমের চারদিকে ধোঁয়া।

তাসলিমা আকতার আরও বলেন, আমি ক্লাসে ঢুকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে বাধা দেয়। আমি কাঁদছি, ছুটছি, আল্লাহকে ডাকছি। আমি বারবার ঢুকতে চাইলাম জোর করে ঢুকতে চাইলাম আমাকে বাধা দিল দুজন আমাকে জোর করে এক পাশে নিয়ে গেল। আমি ডানপাশে ঘুরেই দেখি আমার ছেলের ফোন মাস্টার বাবুল স্যার। জিজ্ঞেস করলাম স্যার আপনি এখানে আমার ছেলে কই???

‘শুধু হাতটা ধরে বলল ওরা ওপরে দুই তালায়। বিশ্বাস করলাম না তারপর আমার একজন ছাত্র এসে বলল ম্যাডাম কিছু হয় নাই এই পাশে আসেন। ক্যান্টিনের পাশে ওপরে ৭ থেকে আটজন মেয়ে বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছিল। আমি আল্লাহর কাছে কি দোয়া পড়ছিলাম আমার কিছুই মনে নাই। আমার বিভাগের আমার একজন সহকর্মী মুকুল স্যার এর ভাগ্নিও ওই ভবনে আটকা পড়ছেন। উনি দৌড়াচ্ছেন আর চিৎকার করছেন।’

‘আমাকে দুইজন সেনা সদস্য বসায় দিয়ে ধরে রাখলেন একপাশ থেকে। যেন আমি সামনে না যাই। তারপর দোতলার সামনে গাছ ছিল আম গাছ কেটে ফেলা হলো। গ্রিলের তালা ভাঙ্গা হলো একপাশ ভেঙে ফেলা হলো। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি কিছু ছাত্রী গ্রিলের নিচ দিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসছে। ৮ থেকে ১০ জন ছাত্রী এবং একজন ম্যাডাম বের হওয়ার পর হঠাৎ আমার ছেলের চেহারা ভেসে উঠলো।’

তিনি বলেন, ওই মুহূর্তটা একজন মায়ের জন্য কি মুহূর্ত, সেটা বলে বোঝানো যাবে না লিখেও শেষ করা যাবে না। আমার মানিককে আমার সন্তানকে আমি জরিয়ে ধরলাম। যারা আমার ছেলের ক্লাসে আটকে ছিল তারা কেউ বেঁচে ফিরে নাই। সবাই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।

দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন। রাত ৮টা ১৫ মিনিটে তাসলিমা আকতার যখন আবার দুর্ঘটনাস্থলে যান, তখনও ধোঁয়া উঠছে, আর উদ্ধারকারীরা জানাচ্ছিলেন আরও একটি পোড়া মরদেহের খণ্ডাংশ খুঁজে পাওয়ার কথা।

তাসলিমা আকতার বলেন, হে রাহমানুর রাহিম, তুমি উত্তম পরিকল্পনাকারী, কিন্তু এমন মৃত্যু কেন শিশুর জন্য? বাবা-মা যেন তাদের সন্তানের গলে যাওয়া দেহের শেষটাও দেখতে পায় না — এ কেমন ভাগ্য?

এই সাক্ষ্য শুধু একটি মায়ের নয়, বরং হাজারো পরিবারের হৃদয়ের আর্তনাদ। এই ঘটনা কেবল একটি বিমান দুর্ঘটনা নয়, এটি বহু পরিবারকে অনন্ত বেদনার মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছে।

Scroll to Top