কেন সিরিয়ায় আসাদের নাটকীয় পতন হলো?

কেন সিরিয়ায় আসাদের নাটকীয় পতন হলো?

নির্বাচনের বছর বলা হয়েছিল ২০২৪ সালকে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এবার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু বছর শেষে বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, সিরিয়া এবং আরও অনেক দেশে গণআন্দোলন, সংঘাত ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ২০২৪ নামক বছরটিকে দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত রাজনৈতিক পর্বান্তরের পটভূমিতে।

বছর শেষের প্রাক্কালে যে প্রশ্নটি বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলেছে, তা হলো, কেন সিরিয়ায় আসাদের নাটকীয় পতন হয়েছে? দ্রুততম ও অভাবনীয় এই পতনের নেপথ্য কার্যকারণগুলো কি ছিল? যদিও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের সাথে সুপরিচিত এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্যের বন্যা বইছে। অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে এবং কেন তার শাসন এত দ্রুত পতন হল। তথাপি সিরিয়া নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায় নি।

বিজ্ঞাপন

বিশেষত, প্রবীণ সিরিয়ান সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক হাসান হাসানের এক্স-এর একটি পোস্টে উত্থাপিত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর এখনও বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি বলেছেন যে, “সিরিয়া বিষয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত উত্তর নেই। এখনও অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা বাকি।” তার মতে, “আসাদের অনুগত বাহিনী ছিল অন্তত কিছু সময়ের জন্য দামেস্ককে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্ত তারা কেন হাল ছেড়ে দিল, তার কোন সদুত্তর নেই।

তিনি মনে করেন, “দামেস্কের কাছে এটি পরিষ্কার ছিল যে পুরো দেশের বেশিরভাগ অংশে যুদ্ধ করতে অক্ষম ছিল আসাদের শাসন ও সৈন্যদল। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয়, কেন তারা রাজধানী রক্ষার যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা কোনও ঘোষণা ছাড়াই পরিত্যাগ করেছিল? এটি কখন ও কেমন করে হলো, তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি কোনও সূত্রের পক্ষেই।”

বিজ্ঞাপন

হাসান আরও বলেন, “আসাদের কাছে লড়াই করার জন্য সবচেয়ে প্রশিক্ষিত এবং অনুগত বাহিনী ছিল, কিন্তু তারা রাজধানী ছেড়ে পালালো কেন? যদিও সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে আসাদের অনেকগুলো শক্তিশালী ঘাঁটিতে অনুগত ইউনিটগুলে লড়াই করতে ইচ্ছুক ছিল। রাজধানীর আকস্মিক পতন ঘটায় তারাও হতাশ আর নেতৃত্বহীন হয়ে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করে।”

হাসানের মতো আরও অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, “তাহলে কেন সেনাবাহিনী আসাদকে সম্পূর্ণরূপে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে পরিত্যাগ করল অপেশাগত পদ্ধতিতে?” পশ্চিমা গ্রেগরি ওয়াটার্স এবং সিরিয়ার মুহসেন মুস্তাফার মতো বিশ্লেষকরা একাধিক কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা গত কয়েক বছরে সামরিক সংহতি এবং প্রস্তুতিকে ক্ষুণ্ন করেছে, যার মধ্যে কয়েক হাজার অফিসার এবং সৈন্যকে রিজার্ভে স্থানান্তর করার ঘটনা রয়েছে। এতে, সক্রিয় এবং রিজার্ভ উভয় ধরনের সৈন্যদের পেশাগত জীবনযাত্রার মান মারাত্মক ক্ষয় হয়েছে। তাছাড়া, সংরক্ষিত কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও দুর্নীতির ফলে বেতন আত্মসাৎ এবং খাদ্য সরবরাহের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় আসাদের সামরিক শক্তি ভঙ্গুর হয়েছে। সর্বোপরি, রাশিয়া, ইরান এবং হিজবুল্লাহর কাছ থেকে যে ধরনের সামরিক সহায়তা আসাদ-শাসনের টিকে থাকার চাবিকাঠি ছিল, শেষ দিকে পর্যাপ্ত ছিল না।

কেন সিরিয়ায় আসাদের নাটকীয় পতন হলো?


আসাদের পতনের ঘটনা থেকে কর্তৃত্ববাদী আরব রাষ্ট্রগুলো এই সামরিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা পেতে পারে যে, বাইরের সাহায্যে ভেতরের সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়। আসাদ পতনের ঘটনাবলি এই দরকারী অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে যে, জনবিচ্ছিন হলে ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব। তদুপরি, জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে রাজনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা শাসনের অবক্ষয় নিয়ে আসে। সিরিয়ার অভিজ্ঞতায় আরব বিশ্বের দেশগুলোতে আগামী দিনে শাসন ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ককে আরও জনমুখী করার প্রয়োজনীয়তা প্রকট হচ্ছে।

উত্তাল আরব বিশ্বে অভ্যুত্থান ও গণবিক্ষোভ তীব্র হয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটালেও সিরিয়া এসব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তবে, ২০১১ সালে মিশর এবং লিবিয়ায় এবং ২০১৯ সালে আলজেরিয়া এবং সুদানে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাধারণ কারণের মধ্যে অন্তত একটি সিরিয়ার আসাদ সরকারের শেষ দিনগুলোতে দৃশ্যমান হয়েছিল। অন্যান্য আরব দেশের মতো সিরিয়ায় যখন জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয়েছিল, তখন সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনগণের সঙ্গে বোঝাপড়ায় পর্যুদস্ত হয়েছেন, আর তখনই কর্তৃত্ববাদী শক্তির প্রধান নোঙ্গর এবং শাসনের স্থায়িত্বের গ্যারান্টার হিসাবে সামরিক বাহিনী তার ভূমিকা স্থগিত করেছে।

২০২৪ সালে সিরিয়ায় যা হয়েছে, তা ২০১১-২০১২ সালে হয় নি। তখনকার জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের হুমকির কারণে আসাদ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়নি। তবে শাসনের প্রতিটি সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষয় শুরু হয়েছিল অল্প অল্প করে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধকালীন বাস্তুচ্যুতি এবং রাষ্ট্রীয় ঋণের ক্ষতির কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি বৃহৎ চাষি শ্রেণি, এবং একটি ব্যবসায়িক খাত যা বারবার ঝাঁকুনি এবং পতনের মুখোমুখি হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে, আসাদ একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সাথে একটি অন্তর্নিহিত চুক্তি ভঙ্গ করেছেন বলে মনে হচ্ছে যেটি তার প্রতিরক্ষায় হাজার হাজার লোককে হারিয়েছে। ক্রমাগত অবনতিশীল জীবনযাত্রার মান এবং সরকারী খাতে আয়ের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আস্থায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতির অন্তহীন চক্রের পতন ঠেকাতে পারে নি।

সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডের মধ্যে এই ধারণা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি একটি সংকটময় মুহূর্তে বিদেশি সামরিক বা আর্থিক সহায়তার সুবিধা নিতে পারছেন না। এর আনুমানিক কারণগুলো ছিল, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, ইরানের অবক্ষয়, কৌশলগত প্রতিরোধ এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক ক্ষয়ক্ষতি, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে আসাদের হাতের বাইরে। অন্য চারটি আরব দেশে অতীত দৃষ্টান্তে দেখা যায় যে, একজন প্রেসিডেন্টের বিদেশি সমর্থন বা সামরিক নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করার ক্ষমতার প্রকৃত বা সম্ভাব্য ক্ষতি তাকে রক্ষা করতে বা পরিত্যাগ করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সিরিয়ার একদিকে, সমাজ ও রাজনীতির সামরিকীকরণ এবং কয়েক দশক ধরে শাসনের স্তম্ভ হিসাবে সেনাবাহিনীর দ্ব্যর্থহীন ভূমিকা সত্ত্বেও, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আরব প্রতিপক্ষদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। হাস্যকরভাবে, আসাদের অনানুষ্ঠানিক কন্ট্রোল নেটওয়ার্কের সাথে এর আনুষ্ঠানিক কমান্ড স্ট্রাকচারের আন্তঃসংযোগের অর্থ হল যে তিনি এর সংহতি রক্ষা করতে এবং গৃহযুদ্ধের সময় এটির টিকে থাকা নিশ্চিত করার চেয়ে বেশি করেছিলেন তার ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য। অতি সম্প্রতি, একটি সঙ্কুচিত অর্থনীতি থেকে আয় কমানোর বিষয়ে তার বিভ্রান্তির মধ্যে এই ফাংশনটির প্রতি তার অবহেলা, সেনাবাহিনীর সংহতিকে আরও দুর্বল করেছে। অন্যদিকে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। সেনাবাহিনীতে আসাদপন্থী আলাভি সম্প্রদায়ের নিয়োগের উপর অত্যধিক নির্ভর করে শাসনের টিকে থাকার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সেনা প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যর্থ করেছে। যদিও সামরিক বাহিনী দীর্ঘকাল ধরে এবং নিজের মধ্যে একটি প্রধান পাবলিক সেক্টর নির্বাচনী প্রতিনিধিত্ব করেছে ও এটিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার একটি হাতিয়ার হিসাবে অপরিহার্য করে তুলেছে, তথাপি আসাদের রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের বাকি অংশের দরিদ্রতা থেকে রক্ষা করতে আসাদের অক্ষমতা তার উপর সেনা আস্থা হ্রাস করেছে।

সিরিয়ার বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের এই পাঠ থেকে একটি চূড়ান্ত, আশাব্যঞ্জক প্রভাব হল যে দামেস্কে যা ঘটেছিল তা ২০১১ সালে মিশরে যা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি নয়, যখন সশস্ত্র বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারককে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিল। তাদের অবস্থান এবং মূল শাসন সংরক্ষণ, অথবা যখন আলজেরিয়ান এবং সুদানী সেনাবাহিনী ২০১৯ সালে একই কাজ করেছিল। সিরিয়ার কয়েক ডজন সিনিয়র সেনা কমান্ডার যারা আসাদের শাসনের শেষ দিনে দামেস্কে থেকে যাওয়া হয়তো তাকে বলেছিল যে তারা তার পক্ষে লড়াই করবে না এবং তাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে। যাইহোক, তাদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অভ্যাসের অভাব ছিল এবং সিরিয়ার রাজনৈতিক রূপান্তর বাতিল করতে এবং তাদের নিজের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। ফলে সিরিয়ার ক্ষমতা আসাদের কাছ থেকে কোনও সামরিক জেনারেলের হাতে যায় নি। জেনারলগণ নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে পুরো সেনাবাহিনী সমেত রণাঙ্গন থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য বিদ্রোহীদের সামনে মসৃণ পথ তৈরি করে দিয়েছেন। সেই পথে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরেক দিক থেকে ইসরায়েল আক্রমণ ও আগ্রাসন চালিয়েছে সিরিয়ায়।

সিরিয়ায় আসাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদ দেশটির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শক্তি ও সামর্থ্যের যে চরম ক্ষতি করেছে, তার দায়ভার সিরিয়াকে ভোগ করতে হচ্ছে চারদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।