কাপড়ের দোকনে মিলল ১৪ ফুট লম্বা এক অজগর!

কাপড়ের দোকনে মিলল ১৪ ফুট লম্বা এক অজগর!

অপু: দিদি রেলের গাড়ি দেখেছিস?

দুর্গা: হ্যাঁ

অপু: রেলের রাস্তা কোথায় জানিস, কোথায় রে?

দুর্গা: ওই তো, সোনাডাঙার মাঠ, তারপর ধানখেত, তারপর রেলের রাস্তা।

অপু: একদিন যাবি?

তারপর একদিন, শরৎকালের বিকেলবেলা। দিগন্ত বিস্তৃত সাদা কাশফুলের আড়াল থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের-‘কু ঝিক ঝিক’। কোথা হতে আসছে সেই সুমধুর ডাক, কান পেতে প্রাণপণে সেদিকে ছুঁটছে অপু-দুর্গা, দুই ভাইবোন। একটু পরেই ধরা দিল সেই অনন্য মুহূর্ত, কালো ধোঁয়া উড়িয়ে সাপের মতো এগিয়ে আসছে রেলগাড়ি। দু চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখছিল অপু-দুর্গা। কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর সেই অমর ফ্রেম, যা বাঙালির নস্টালজিয়ায় চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। দৃশ্যটা সাদা কালো বটে। কিন্তু ৭০ বছরের পুরনো সেই ফ্রেমটা আজও যেন রঙিন হয়ে গেঁথে আছে ট্রেনপ্রেমী প্রতিটি মানুষের মনে, একেবারে টাটকা হয়ে!

অপু-দুর্গার সেই ছবিটা যেন এবার বাস্তব কক্সবাজারেও। পাহাড় জঙ্গল আর সমুদ্রের প্রতিবেশি পর্যটননগরীতে ১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ছোঁটে বাণিজ্যিক ট্রেন। গ্রামের পর গ্রামের প্রত্যন্ত পথ ধরে সেই ট্রেন যাত্রার ‘মধূচন্দ্রিমা’ চলছে এখনো। একইদিনে দুইবার ঢাকা-কক্সবাজার, কক্সবাজার-ঢাকায় আসা যাওয়ার মাঝে ৬৯২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া কক্সবাজার এক্সপ্রেস ‘ঘুম ঘুম চোখ’ আর ‘ক্লান্ত পায়ে’ এগিয়ে গেলেও যেন বিরতি নেই শিশুদের আগ্রহের। প্রতিদিন তাই রেললাইন থেকে দূর নয় এমন পথে দাঁড়িয়ে সেই ট্রেনের দেখতে অপু-দুর্গার মতো জমছে অবাক শিশু-কিশোরের জটলা। তাঁদের কেউ প্রথমবার ট্রেন দেখছে, কেউবা বারাবার দেখছে-কিন্তু কৌতূহল যে ফুরায় না।

কাপড়ের দোকনে মিলল ১৪ ফুট লম্বা এক অজগর!

সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ব্রিটিশ শাসনামলের স্বর্ণযুগ। ক্যালেন্ডারের হিসেবে দিনটি ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সেইদিন প্রথমবারের মতো রেলগাড়ির পা পড়ে বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি ব্রডগেজ রেলপথ ধরে পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট থেকে একটি ট্রেন এসে থামে কুষ্টিয়ার এক রেলস্টেশনে। যে স্টেশনের কাগুজে নাম ‘জগতি’।

এরপর ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে রেলপথের শরীর। সেই ধারাবাহিকতায় অবিভক্ত আসাম রেলওয়ে ১৯২৯-৩১ সালে চট্টগ্রাম শহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ কিলোমিটারের রেলপথ নির্মাণ করে। এরপর কেটে যায় কত মাস, বছর, দীর্ঘ সময়। কিন্তু দক্ষিণে আর এগোয়নি রেলপথের দৈর্ঘ্য। দোহাজারি এসে ট্রেন থেমে যেত বলে অনেকেই এর নাম দেন-আখেরি স্টেশন। যে স্টেশন ঘিরে গত শতাব্দির  ষাটের দশকে তখনকার জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী রহমান-শবনমকে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘আখেরি স্টেশন’ নামের সিনেমাও। মানুষের আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা স্টেশনটি ঘিরে মুগ্ধতা তাই থাকত বারোমাস। তবে ধীরে ধীরে ট্রেনের অভাবে সেই স্টেশনটি হয়ে পড়ে বড্ড নিঃসঙ্গ, মুখর অপেক্ষাকক্ষ হয়ে যায় প্রায় পরিত্যক্ত। সেই ভাটায় পানি আসে রেলপথ ঘুমধুম পর্যন্ত প্রসারের উদ্যোগ নেওয়ার পর। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার লাইন অবশ্য এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। কক্সবাজারবাসীর শত বছরের অপেক্ষাও তাই ফুরিয়ে গেছে এক লহমায়।

এই ট্রেনকে ঘিরে আবেগের বিস্ফোরণ তাই দেখা যাচ্ছে একটু বেশিই। কেননা ট্রেনে চড়া তো দূরের কথা, লাইন দিয়ে ছুটে যেতেও দেখেনি এই জেলার অনেক মানুষ। সেই ট্রেন এখন হাতের কাছেই। তাই তো ট্রেন দেখার জন্য পড়া ফেলে ছুটে আসছে ছেলেমেয়েরা। হুইসেল বাজলে কাজের ফাঁকে এসে বড়রাও দু চোখ ভরে ট্রেন দেখার সাধ মেটাচ্ছেন। এ যে অধরাকে দেখার আনন্দ, অচেনাকে চেনার আনন্দ!

ফসলের মাঠ, নদী আর বনভূমি পেরিয়ে চকরিয়া স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে মনে হবে এই তো পথের পাঁচালীর সেই এক টুকরো নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম। শরৎ অতীত হয়েছে বলে সেই কাঁশফুল নেই বটে, কিন্তু রেললাইনের দু ধারে মাথা দোলানো ধান-সবজি গাছেরা মনে করিয়ে দেয় গ্রামের অপার সৌন্দর্য!


সেই পথ ধরে ট্রেন রাজকীয় চালে হেলেদুলে ভেঁপু বাজিয়ে এগিয়ে গেলেই ধান খেতের বুক চিরে গড়ে উঠা আইল ধরে দৌড়ে দৌড়ে আসে ‘অপু-দুর্গার’ দল। বাণিজ্যিক ট্রেন চলার প্রথমদিন সেই দলে ছিল স্কুলশিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। ১০ বছরের আবদুল্লাহ একরাশ বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে বলল, ‘বইয়ের পাতায় দেখেছি ট্রেনের ছবি, বাস্তবে কোনদিন দেখিনি। তাই ভেপু বাজতেই দৌড়ে আসি। সাপের মতো লম্বা শরীর, একেবেকে এগিয়ে আসছে। আবার দেখছি বড় বড় শিসও দিচ্ছে। শুরুতে তাই ভয় পাই। কিন্তু একটু পর সেই ভয় কেটে যায়। উপভোগ করি ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার সৌন্দর্য।’ এ যেন ভয় থেকে ভক্তির গল্প!

আর যারা প্রথমবারের মতো ট্রেনে চড়ে ঢাকায় গেল তাঁদের উচ্ছ্বাসও তো আরও বেশি। সেই দলে ছিল বেসরকারি কর্মকর্তা আবদুর রশিদের শিশুকন্যা নাদিয়া সোলতানাও। বাবার ফোনে নাদিয়া বলল, ‘সাঁ সাঁ করে ট্রেন ছুটছে। জানলার বাইরে দ্রুতই পেছনে চলে যাচ্ছে গাছপালা, সবুজ মাঠ। এলোমেলো হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের চুল। প্রথমবার ট্রেনে চড়ার এই স্মরণীয় অভিজ্ঞতা বড় হলেও মনে থাকবে।’

কোনো কাজ ছিল না, তবুও প্রথম ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন আসিফ আসহাব। পরদিন আবার ফিরিও এসেছেন ট্রেনে। এই তরুণ বললেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি পথের পাঁচালীতে ট্রেন ঘিরে দুই ভাই-বোনের আবেগ দেখে ভেবেছিলাম, আসলেই কি এমন হয়? একটা বাহন নিয়েই এত উচ্ছ্বাসের ঢেউ? আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ট্রেনে একবার চড়ে। কক্সবাজার থেকে যতই ট্রেন চট্টগ্রামের দিকে এগিয়েছে ততই দেখেছি দুই ধারে মানুষের ঢল। কেউ কাজ ফেলে বিলের মাঝ খান দৌড়ে আসছেন, কেউবা বেরিয়ে আসছেন ঘর থেকে। সত্যিই প্রথম দেখার আনন্দের সঙ্গে কিছুর তুলনা হয় না।’

দিন ফুরোলে নাকি উৎসব গত হয়ে যায়, উদযাপন হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ! কিন্তু কক্সবাজার এক্সপ্রেসকে ঘিরে আবেগের ফল্গুধারা যেন বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো বইতে থাকবে আরও বহুদিন। তাই তো ট্রেনের গায়ে ছুঁড়ে মারা ভালোবাসার ফুল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আবার পড়ছে ফুলের আঁচড়। শত বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া বহু আরধ্যের এই ট্রেন যে নয় শুধু কোনো বাহন, এ তো এই অঞ্চলের মানুষের আবেগের উৎপত্তিস্থল!

Scroll to Top