সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে একটি নাটক দেখার সময় প্রথম একটি জুয়া খেলার সাইটের বিজ্ঞাপন দেখতে পান মালয়েশিয়া প্রবাসী জাকির (ছদ্মনাম)। বেশ কয়েকবার এড়িয়ে গেলেও একসময় আকর্ষণ বোধ করেন তিনি এবং তিন কার্ড নামে একটি খেলায় জড়িয়ে পড়েন। প্রথম ৩ দিনেই ১০০ রিঙ্গিত ব্যয় করে প্রায় ১ হাজার রিঙ্গিত আয় করেন তিনি। খেলাটায় আশক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এমনকি কাজে যোগ না দিয়ে অনলাইন জুয়ায় মজে উঠেন। কখনো আয়, কখনো ব্যায় এই অংক কষতে কষতে প্রায় ২০ দিন পর দেখতে পান প্রায় ১০ হাজার রিঙ্গিত (প্রায় ২ লাখ টাকা) হারিয়েছেন তিনি।
কেন এমন খেলায় আসক্ত হলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মজা করতে করতেই খেলা শুরু করি। তবে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনন্দ প্রাপ্তি ছাড়াও হতাশা, একাকিত্বে এবং টাকা পরিশোধের ভাবনা থেকেই এই অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। মধ্যপ্রাচ্যে এই ধরনের অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ব্যবহারে অনেকক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকলেও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এসব দেশে একেবারেই সহজ প্রবেশ রয়েছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার ক্লাং ভ্যালিতে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত দুটি কল সেন্টারে অভিযান চালায় মালয়েশিয়া পুলিশ। এই দুটি কল সেন্টার থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাঝে অনলাইন জুয়া প্রচার করা হতো।
অভিযানের সময় ৬ জন বিদেশিসহ ১২ জন সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। এদের সবার বয়স ১৯ থেকে ৩৭ বছরের মধ্যে। এ সময় কম্পিউটার, মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, এক্সেস কার্ড, তিনটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।
ব্রিকফিল্ড পুলিশের প্রধান এসিপি আইহিজান আবদুর সুকর জানান, আটককৃতরা এই কলসেন্টারের তত্বাবধায়ক এবং কাস্টমার সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরা অনলাইন জুয়ায় অংশ নেয়া বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো এবং নতুন অফার প্রচার করতো।
তিনি বলেন, অনলাইন জুয়া জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এরা প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। জুয়ার আশক্তি থেকে সাধারণকে রক্ষা করতে এই ধরনের অভিযান চলমান থাকবে।
অনলাইনে জুয়ার সাইটগুলো বাংলাদেশিদের টার্গেট করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানান তিনি।
এর আগে ২০২১ সালে কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে অনলাইন জুয়ায় জড়িত বাংলাদেশিদের আটক করা হয়েছিল। যারা মানবপাচারের শিকার হয়ে কম্বোডিয়াতে বাধ্য হয়েছিল অনলাইন জুয়াখাতে কাজ করার জন্য।
তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন লন্ডন প্রবাসী মাহমুদ খায়রুল। তিনি বার্তাকে বলেন, প্রবাসীদের লক্ষ্য করে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রদান করা অনেক সহজ। এক্ষেত্রে দ্রুত ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়।
মাসিক আয়, স্থান, পেশা এবং শিক্ষার স্তর ভেদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, ইমো’তে বিজ্ঞাপন দেয় জুয়া পরিচালনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও এমন অনেক অ্যাপস রয়েছে যেগুলো কয়েক ঘণ্টার জন্য বা কয়েক দিনের জন্যই তৈরি করা হয়।
এই ধরনের অ্যাপস বা সাইট কয়েক লাখ হতে পারে। এটার কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
জুয়া বা গেমিংয়ের ক্ষেত্রে অল্প পরিমান টাকা থেকে বিনিয়োগ শুরু হয়। বাংলাদেশি টাকায় ১০০ টাকা থেকেও শুরু হতে পারে। কিন্তু পরিচালনাকারী যখন দেখবে ব্যবহারকারী একসঙ্গে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছে, চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই সেই অ্যাপ বা সাইট বন্ধ করে দিতে পারে। সেখান থেকে টাকা ফিরে পাওয়ার আর কোন উপায় থাকে না।
বেসরকারি সংস্থ্যা ব্রাকের সহকারী পরিচালক ও মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান বার্তা২৪.কম’কে বলেন, বিগত ১৫ বছরে বিদেশে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন হৃদরোগ এবং স্ট্রোকে। এর কারণ হিসেবে শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতাও রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রবাসীদের অনলাইন ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা একাকিত্বে বা বন্ধুহীনতার ফলে এই ধরনের সাইটে বা অ্যাপে ঝুঁকছে। প্রবাসীরা যখন ফোন দেন দেশে বন্ধু বা স্বজনদের কাছে। তারা দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলতে চান। কিন্তু আমরা সবসময সেই সময় দিতে পারি না। তখন নিজেদের সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে বিনোদন খোঁজেন তারা। যা অনেক সময় ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে।
শরীফুল হাসান বলেন, প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ থাকবে যে কোন মাধ্যমে অর্থ প্রদানের পূর্বে যে কারো সঙ্গে যেন সেটা শেয়ার করেন। মানসিক সুস্থ্যতার জন্য সহকর্মী বা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারেন। যে কোন দেশেই প্রবাসীদের মধ্যে একটি সচেতন ও শিক্ষিত গোষ্ঠী রয়েছেন। তারা অন্যদের সচেতন করতে পারেন। দূতাবাসগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের সংযুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের আয়োজনও করতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয় বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের পরিবারের প্রবাসী সদস্যকে ফোনে বা যে কোন যোগাযোগমাধ্যমে সময় দিতে হবে। তার কথাগুলো শুনতে হবে।