কোডিং বা গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হলেও, লেখালেখির জগতে এই প্রযুক্তির প্রবেশ অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। বিশেষত সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য বা সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে এআই -এর ব্যবহার ঘিরে উঠছে নৈতিকতা, মৌলিকতা ও সৃজনশীলতা নিয়ে নানা প্রশ্ন।
আজ (১৯ আগস্ট) মঙ্গলবার জিও নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পাকিস্তানি গবেষক ডা. ডুরে নায়াব জানিয়েছেন, আজ যখন এআই কারও ইংরেজি দুর্বলতা, পেশাগত সম্পাদনার অভাব বা ভাষাগত প্রান্তিকতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ ও পরিশীলিত লেখায় সহায়তা করছে, তখন অনেকের জন্য এটা শুধু অস্বস্তিকর নয়, ভয়াবহও বটে।
বিজ্ঞানে এআই হিরো, লেখালেখিতে ভিলেন!
প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে এআই ব্যবহারে কোনো বিতর্ক নেই। বরং দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রশংসা পায় ব্যবহারকারীরা। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে এআই সহায়ক হলেই সেটা ‘প্রতারণা’—এই ধারণা কেন?
লেখকের মতে—ভাষা, বিশেষত পরিশীলিত ইংরেজি, বহুদিন ধরে সমাজে এক ধরনের শ্রেণি চিহ্ন হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের মতো উপনিবেশ-উত্তর সমাজে ‘ভালো ইংরেজি’ শুধু দক্ষতা নয়, অনেক সময় মর্যাদার প্রতীক। আর যাদের এই মর্যাদা অর্জনে বছরের পর বছর লেগেছে, হঠাৎ এআই এসে যদি সেই গেট খুলে দেয়, তাহলে এটা আর কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, একটি সামাজিক ধাক্কাও।
সম্পাদক বৈধ, এআই অবৈধ—কেন এই বৈষম্য?
ডা. ডুরে নায়াব প্রশ্ন তুলে বলেন, কয়েক দশক ধরে লেখকরা বানান ও ব্যাকরণ ঠিক করতে সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন, গবেষকরা ‘গ্রামারলি’ এর মতো সফটওয়্যারের সহায়তা নিচ্ছেন, লেখকেরা পেশাদার সম্পাদক রাখছেন। তাহলে এআই যদি লেখার কাঠামো ঠিক করে দেয় বা ভাষা সহজ করে তোলে, তাহলে সেটা কেন অবৈধ হয়ে যায়? যদি যুক্তি ও চিন্তা মানবিক হয়, তথ্য মৌলিক হয়, তাহলে প্রকাশের মাধ্যমে এআই কিছু সাহায্য করলেই কি সেটি ভুয়া হয়ে যায়? নাকি আসল সমস্যা হলো—এআই সহজলভ্য, সস্তা এবং এতে কোনো এলিট সংযোগ দরকার পড়ে না?
ভয়ের গভীরে ‘গেটকিপিং’ এর রাজনীতি
ডা. ডুরে নায়াব বলেন, মূল প্রশ্ন এখানে লেখার মান নয়, বরং লেখক কে হবেন—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কে রাখবে? ঐতিহাসিকভাবে ইংরেজি ভাষায় লেখা; বিশেষত ‘সঠিক ইংরেজি’ ছিল সেই টিকিট যা কাউকে বৈশ্বিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিত। কিন্তু আজ যদি একটি ছোট শহরের কোনো ছাত্র এআই-এর সহায়তায় জটিল চিন্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে, তাহলে তো খেলার মাঠ সমান হয়ে যাচ্ছে এবং এটাই হলো কিছু মানুষের ভয়। একজন স্নাতক-পূর্ব নাইজেরিয়ান নারী হয়তো হাভার্ডে না পড়েও এখন ভাইরাল কলাম লিখতে পারেন, একজন সিন্দুর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্র হয়তো দুর্বল ইংরেজি থাকা সত্ত্বেও নিজের গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে পারেন। এই সমতা নতুন নয়, কিন্তু এআই এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করছে।
ব্যবহার নয়, নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ
লেখকের মতে, এটা সত্য যে পুরোপুরি এআই-নির্ভর লেখা যেখানে চিন্তা ও ভাবনা মানবিক নয়, সেটা অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এআই যদি লেখাকে আরও পরিস্কার, সুসংহত ও পাঠযোগ্য করে তোলে, এবং লেখকের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত থাকে—তাহলে সেই লেখাকে অবৈধ বলা কতটা যৌক্তিক? এআই এখানে সম্পাদক, অনুবাদক বা মেন্টরের মতোই এক সহযোগী মাত্র। পার্থক্য একটাই—এআই ‘এলিট’ নয়, ‘অ্যাক্সেসিবল’।
এআই শত্রু নয়, সম্ভাবনার দরজা
লেখক বলেন, লেখা কখনও বিলুপ্ত হবে না—এটি শুধু রূপান্তরিত হচ্ছে। যেমন ক্যালকুলেটর গাণিতিক চিন্তা শেষ করেনি, তেমনি এআই-ও লেখার মৃত্যু ঘটাবে না। বরং তা আরও মানুষকে লেখার সুযোগ করে দেবে, নতুন ভাবনাকে জায়গা দেবে, এবং সেই সব কণ্ঠস্বরকে সামনে আনবে, যারা এতদিন ভাষার দৌড়ে পিছিয়ে ছিল।
এআই নিঃসন্দেহে নানা সমস্যার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু সঠিক ব্যবহারে এটি হতে পারে সবচেয়ে বড় ভাষাগত গণতন্ত্রের হাতিয়ার। লেখার ভবিষ্যৎ কেবল অভিজাতদের নয়—সবার। আর এআই সেই পথকেই সুগম করছে।