বছরের পর বছর ধরে রাজধানীর উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে গড়ে উঠেছে একাধিক জনপ্রিয় শুটিং হাউজ। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আধুনিক গৃহস্থালী অবকাঠামো এবং নিরিবিলি রাস্তাঘাটের কারণে নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতাদের কাছে এসব বাড়ি হয়ে উঠেছে নির্ভরযোগ্য লোকেশন।
বিশেষভাবে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত ‘লাবণী’ ও ‘আপনঘর’ শুটিং বাড়িগুলোর খ্যাতি অনেক পুরোনো। এই দুই শুটিং বাড়ির মালিকদেরও ভাষ্য, গত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে এখানে নিয়মিতই শুটিং হচ্ছে, কখনোই কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। কিন্তু এবার ‘একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে’ প্রথমবারের মতো শুটিং কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ পেলেন।
উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে শুটিং কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে লাবণী-৪, লাবণী-৫ এবং আপনঘর এর মালিকদের নোটিশ পাঠানো হয়। ২০ জুলাই সমিতির সভাপতি মেজর আনিসুর রহমান (অবঃ) এবং সাধারণ সম্পাদক মর্তুজা আলীর স্বাক্ষরিত এক নোটিশে জানানো হয়, “শুটিংয়ের কারণে রাস্তায় জনসমাগম বাড়ছে, যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে এবং শান্তিপূর্ণ বসবাস ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শুটিং সম্পূর্ণরূপে নীতিমালার পরিপন্থী।”
নোটিশে আরও বলা হয়, সেক্টরবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এবং সবার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অনতিবিলম্বে শুটিং কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।
এই ঘোষণার ফলে সেক্টর-৪ এর ‘লাবণী ৪’, ‘লাবণী-৫’ এবং ‘আপনঘর’ শুটং বাড়ির মালিকরা রীতিমত হতবাক। এই তিনটি শুটিং বাড়ির মালিকদের সাথেই কথা বলে চ্যানেল আই অনলাইন।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছুদিন আগে ‘আপনঘর শুটিং হাউজ’-এ একটি প্রামাণ্যচিত্রের শুটিং চলছিল। শুটিং ইউনিটটি সেখানে ‘জুলাই আন্দোলন’-নির্ভর একটি গল্প চিত্রায়ন করছিল। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই একটি দৃশ্যে দেখা যায়, কিছু আন্দোলনকারী রাতে মশাল মিছিল করছেন। সেই দৃশ্যধারণের সময় স্থানীয় অনেকেই বুঝতে পারেননি ঘটনাটি আসলে একটি নির্মাণাধীন দৃশ্য। পরে সেক্টর কল্যাণ সমিতির কিছু সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি দেখেন এবং রাতে জনআতঙ্ক তৈরী হতে পারে- এমন দৃশ্য ধারণের আপত্তি তোলেন। পরবর্তীতে শুটিং হাউজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে এবং শুটিং কার্যক্রম বন্ধে নোটিশ পাঠায়।
এ বিষয়ে ‘আপনঘর’ এর মালিক খলিল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ওই দৃশ্য যেদিন শুটি করা হয়, সেদিন আমি ছিলাম না। কিন্তু যখন রাতে মিছিলের দৃশ্য ধারণের সংবাদটি পেয়েছি, আমি সাথে সাথে শুটিং ইউনিটকে বলে দিয়েছি, এটা যেহেতু আবাসিক এলাকা, এখানে রাতে এমন দৃশ্য শুট করা যাবে না। ওই ইউনিটের লোকেরাও বিষয়টি মেনে নিয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই তারা শুটিং বন্ধ করে দিয়েছেন। ওইটাকে কেন্দ্র করেই হাউজ বন্ধের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এটা কি কোনো বিচার হলো?
খলিল বলেন, আমি ত্রিশ বছর ধরে এই শুটিং হাউজ চালাই। কখনোই এলাকাবাসী বিরক্ত হয়, এমন কাজ করিনি। শুটিং চলাকালে সবকিছুই আমরা মেনে চলি। তাছাড়া একটি শুটিং হাউজের উপর অনেকের রুটি রুজিও জড়িত। আমরা এতোটুকু বলতে পারি, অতীতে যেরকম কাউকে বিরক্ত না করে শুটিং হাউজ পরিচালিত হয়েছে, আগামিতেও সেটা অব্যাহত থাকবে।
লাবণী-৪ ও লাবণী-৫ শুটিং হাউজের মালিক আসলাম হোসাইন বলেন, ২০০০ সাল থেকে এখানে শুটিং হাউজ চালাই, আশপাশের মানুষের সুবিধা অসুবিধা বুঝেই আমরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছি। বিগত ২৫ বছরে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলতে পারেনি। আর এখন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাউজ বন্ধের নোটিশ এলো, এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়।
এসময় রাতে মিছিলের দৃশ্য ধারণের ঘটনাটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যেত বলেও মন্তব্য করেন এই দুই শুটিং হাউজের মালিক।
শুটিং কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ নিয়ে ইতিমধ্যে ডিরেক্টর গিল্ডকে জানানো হয়েছে বলে জানান আসলাম। তাদের পদক্ষেপের দিকেই আপাতত নজর তাদের।
এদিকে ডিরেক্টর গিল্ডের পক্ষে বলা হয়েছে, শুটিং হাউজ বন্ধের বিষয়টি তারা জেনেছেন এবং হাউজের মালিকদের পাশে আছেন বলেও আস্বস্ত করেছেন।
এদিকে সেক্টর-৪ এর শুটিং হাউজ বন্ধের নোটিশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ছোটপর্দার নির্মাতারা ফেসবুক লিখতে শুরু করেছেন। নির্মাতা তপু খান, যিনি ওই এলাকায় দুটি ধারাবাহিক নাটকের কাজ করছিলেন, বলেন, “আমরা মাসের অনেকদিন এখানে শুট করি। হঠাৎ করে এই নিষেধাজ্ঞা শিল্পের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অগণতান্ত্রিক। কেউ যদি অনৈতিক কিছু করে থাকে, তাহলে ডিরেক্টরস গিল্ড, শিল্পী সংঘ ও প্রযোজক সমিতি মিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিক। কিন্তু পুরো শুটিং হাউজ বন্ধ করে দেওয়া সমাধান হতে পারে না।”
অভিনেতা ও নির্মাতা রওনক হাসান বলেন, “আবাসিক এলাকায় শুধু শুটিং নয়, অসংখ্য স্কুল, অফিস, এমনকি নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও চালু আছে। শুটিংকে এককভাবে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা অন্যায়। এর আগেও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশন এবং প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে সমাধান করেছিল। এবারও তেমন সমাধান প্রত্যাশা করছি।”