অনেক অবিশ্বাস্য সত্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। জাকী ভাই নেই- এই অবিশ্বাস্য সত্য নিয়ে আমাদের বাকি জীবন কাটবে।
গভীর শোকস্তব্ধ হৃদয় নিয়ে লেখাটা শুরু করতে হচ্ছে। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী চিরবিদায় নিয়েছেন। এমন জীবন রসিক জীবনজয়ী সজ্জন ও মধুর ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না। সময়ের চেয়ে আগুয়ান মানুষ। এ আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য শোক সংবাদ।
জাকী ভাইয়ের কোন পরিচয় দিব? এমন বহুমাত্রিক ও বর্ণিল চরিত্র আমাদের সমাজে বিরল। তিনি কবি, সাহিত্য সম্পাদক, টিভি উপস্থাপক, ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম, পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ছাত্র, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক, এফডিসির সাবেক মহাপরিচালক, নাটক নির্মাতা, ‘ঘুড্ডি’ নামের বিখ্যাত চলচ্চিত্রের বিখ্যাত নির্মাতা।
এই জীবনে জাকী ভাইয়ের স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম, এ আমার বিরল সৌভাগ্য। চ্যানেল আইতে নিয়মিত আসতেন, আমাদের ভালোবাসার ডাক উপেক্ষা করতে পারতেন না। অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে আসতেন। হুইল চেয়ারে চলাচল করতেন। মুখে সবসময় ছিল ব্যক্তিত্বমাখা মধুর হাসি। শুভ্র কেশ। রুচিস্নিগ্ধ পোশাক। আর উজ্জ্বল দীপ্তিময় চোখ।
জাকী ভাই পড়েছিলেন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে। খুব মেধাবী ছাত্র। ১৯৬২’তে এসএসসিতে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন। কলেজে ভর্তি হবার আগের দিন পর্যন্ত তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন। বিখ্যাত প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দিন আহমেদের অনুরোধে। আমিও ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের ছাত্র। সেই অর্থে জাকী ভাই আমাকে বলতেন, আমীরুল তো আমার ক্লাসমেট। আমরা একই স্কুলে পড়েছি বলেই হা-হা করে হাসতেন। জাকী ভাই এর কথা বলতে গেলে বারবার ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা চলে আসবে। চোখ ভিজে আসবে আমার। কোন কথাটা রেখে কোন কথাটা লিখব? কোন ফ্রেমের পরে কোন ফ্রেমের ছবি সাজাবো?
জাকী ভাইয়ের বাবা ছিলেন বিখ্যাত ঢাকা কলেজের ইংরেজি শিক্ষক। জাকী ভাইও অসাধারণ ভালো ইংরেজি জানতেন। মা ছিলেন নুরুন নাহার। ছড়া কবিতা লিখতেন। লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের একটা বই অনুবাদ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। জাকী ভাই বনেদি পরিবারের সন্তান। পারিবারিক কারণেই শৈশব থেকে ভালো বই পাঠ, ভালো চলচ্চিত্র দর্শন করতেন। সুস্মিত সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। ছোটবেলাতেই সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে কবি গোলাম মোস্তাফা, শিল্পী কামরুল হাসান, কবি সুফিয়া কামাল, শিল্পী সোহরাব হোসেন, শওকত ওসমান সহ এ তালিকা অফুরন্ত।
জাকী ভাই অধ্যয়ন করেছেন ঢাকা কলেজে। জাকী ভাই হাসতে হাসতে বলতেন আমীরুলও ঢাকা কলেজে আমার ক্লাসমেট। পরে জাকী ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে অধ্যয়ন করেন। অসাধারণ ভালো ফলাফল করেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীল বাউল মনের এক ব্যক্তি। ঢাকার জীবনের অনেক বড় বড় মোহ ছেড়ে তিনি পালিয়ে গেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি আসলে ছিলেন জীবনের অনেক বড় শিক্ষক। প্রথাবদ্ধ জীবনের বাইরে সৃজনশীল কাজেই ছিল তার মুক্তি। ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। ‘কাক’ নামে নতুন ধারার একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করলেন। পুনে ফিল্ম ইন্সস্টিটিউটে পড়তে চলে গেলেন। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পেলেন গিরিশ কারনার্ড’কে। মাঝে মাঝে তিনি দেখা পেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটককে। পুনেতে তার সহপাঠি বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত নাসিরউদ্দিন শাহ। চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে জাকী ভাই ছিলেন সুবিদিত। খুব কাছের বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত, বিখ্যাত গৌতম ঘোষ। অনেক গৌরবময়, বর্ণাঢ্য জীবন তার। ১৯৭৮ সালে ‘ঘুড্ডি’ নির্মাণ করে বিখ্যাত হয়ে গেলেন। সেকালে এমন আধুনিক মননের চলচ্চিত্র তিনি কি করে নির্মাণ করলেন অবিশ্বাস্য লাগে।
জাকী ভাই অসাধারণ উপস্থাপক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে স্বনির্বাচিত নামে একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। কবি আহসান হাবিব, শওকত ওসমান, কামরুল হাসান এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিতেন। অসাধারণ প্রশ্নোত্তর চলতো। এখনও স্মৃতিপটে সেই সবই ভাসে।
সাগর ভাই অর্থাৎ ফরিদুর রেজা সাগর তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। সাগর ভাইয়ের কল্যাণে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। জাকী ভাই চ্যানেল আইতে আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করতেন। চ্যানেল আইয়ের কর্মী বাহিনী তাকে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতো। আবদুর রহমান, শহিদুল আলম সাচ্চু, অনন্যা রুমা, আজম বাবু, রেজানুর রহমান, আফসানা মিমি, নায়ক রিয়াজ সবাই ছুটে এসে কুশলাদি শুধাতেন। সময় থাকলে দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া হতো। আর দীর্ঘ আড্ডা চলতো। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর আড্ডা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত অসুস্থ শরীরের দিকে খেয়াল থাকতো না জাকী ভাইয়ের। সাগর ভাইও অফিসিয়াল জরুরি কাজ ফেলে রেখে আড্ডায় মেতে উঠতেন।
জাকী ভাইয়ের প্রিয় সুহৃদরাও আমাদের অতি শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় মানুষ। তারা থাকলে আড্ডা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতো। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, লীনু বিল্লাহ, আল মনসুর, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ উপস্থিত থাকলে আড্ডা কখন শেষ হবে আমরা জানতাম না। হাসি ঠাট্টা আনন্দ কৌতুকে মাতোয়ারা হতাম সবাই।
সাগর ভাইয়ের উদ্যোগে চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে খুব ঘটা করে তার জন্মদিন উদযাপন করতাম। তিনি শিশুর মত খুশি হতেন। অনেক রকমের খেলনা উপহার দিতেন সাগর ভাই। সেদিন দুপুরে জাকী ভাইয়ের সাথে সাত পদের বাঙালি খাবার আমরা একসাথে খেলাম। সবই অনিন্দ্যসুন্দর মধুর স্মৃতি আমাদের।
মনে পড়ে, আমি জাকী ভাইয়ের যে কোনো স্মৃতিলেখায় খুব ভক্ত ছিলাম বারবার তাগাদা দিতাম, আরও লিখুন আরও কিছু লিখুন, পাণ্ডুলিপি শেষ করুন। তার লেখার জন্য তাকে নোটবুক উপহার দিতাম। জাকী ভাই বাচ্চা ছেলের মতো সেই গল্প সবাইকে বলতেন, আমীরুল আমাকে লেখার জন্য খাতা উপহার দিয়েছে। এবার আমি লেখক হবই।
২৬ আগস্ট ২০২৩ ছিল তার জন্মদিন। জাকী ভাই এসেছেন তারকাকথন অনষ্ঠানে অংশ নিলেন। জীবনের গল্প শোনালেন। তারপর সাগর ভাইয়ের রুমে এসে আনন্দে মেতে উঠলেন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা হিসেবে শালের চাদর পরিয়ে দিলেন জাকী ভাইকে। জাকী ভাই সবাইকে নিয়ে ছবি তুললেন। যাবার আগে বললেন আমীরুল ভালো থেকো তোমরা। এবার আমি একটা বই বের করবই। তুমি প্রকাশক প্রস্তুত রাখ। প্রকাশক প্রস্তুত রেখেছি। কিন্তু আপনি এভাবে বিদায় নিলেন কেন? মৃত্যুশয্যা থেকে আপনি বারবার ফিরে এসেছেন। জীবনের কঠিন বাস্তবতা আপনাকে কখনও পরাজিত করতে পারেনি। ‘ঘুড্ডি’র মতো নতুন ধারার চলচ্চিত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। উচ্চপদে কর্মরত থেকেছেন। কিন্তু শিশুর মতো জীবন জয় করেছিলেন। আপনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। আমাদের প্রিয় সুহৃদ। আমাদের সুযোগ হলো সবসময় পাশে থাকতে। সাগর ভাই আপনাকে অসীম শ্রদ্ধা করতেন। জাকী ভাই, কবিতার রক্তক্ষরণ ছিলো আপনার হৃদয়ে। কবিতাময় ছিলো আপনার জীবন।
আমাদের চেতনার অস্তিত্ব জুড়ে আপনি আছেন। আমরা ভাবতেই পারবো না যে আপনার সঙ্গে শারীরিক ভাবে দেখা হবে না। অনেক অবিশ্বাস্য সত্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। জাকী ভাই নেই- এই অবিশ্বাস্য সত্য নিয়ে আমাদের বাকি জীবন কাটবে।