আন্দোলনে নিহত ওয়াসিম নামে ফ্লাইওভারের নামকরণের দাবি

আন্দোলনে নিহত ওয়াসিম নামে ফ্লাইওভারের নামকরণের দাবি

এক স্বামীকে নিয়ে দুই বধূর টানাটানির দৃশ্য দেখা যায় সিনেমাতে। বাস্তবেও কখনো কখনো ঘটে এমন কিছু। তবে এক ঘাট নিয়ে দুই সংস্থার টানাটানি মনে হয় এই প্রথম! বঙ্গোপসাগরের বুকের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের মূল ভূখণ্ড সীতাকুণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান নৌ পথ কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট। সেই ঘাটের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে সরকারি দুই সংস্থা জেলা পরিষদ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

শুরু থেকেই জেলা পরিষদ মালিক হিসেবে এই ঘাট পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু এক যুগ আগে হঠাৎ বিআইডব্লিউটিএ-এই ঘাটের মালিকানা দাবি করে বসে। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্তও। আদালত জেলা পরিষদের পক্ষে রায় দিলে ‘চুপ’হয়ে যায় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নীরবতা ভেঙে ২০২৩ সালে এসে আবারও ঘাটের মালিকানা নিয়ে সরব হয় বিআইডব্লিউটিএ। এখন জেলা পরিষদের পাশাপাশি তারাও ঘাটের মালিকানা দাবি করে ইজারা দিচ্ছে।

ইজারা দিয়ে জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ ‘মধু আহরণে’ব্যস্ত হলেও ঘাটের উন্নয়নে দৃশ্যমান তেমন কোনো কিছুই করছে না দুই সংস্থা। ফলে কোপ পড়েছে পরিষেবায়। সন্দ্বীপবাসীদের হয়রানিও তাই চরমে। দুই ইজারাদার মিলেমিশে কাজ করে আসায় নিজেদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বও না হলেও আছেন বিপাকে। কেননা দুই সংস্থা রাজস্ব নেওয়ায় ইজারাদারদের ওপর চাপ পড়েছে। আর সেই চাপের প্রভাব পড়েছে যাত্রীদের ওপরও।

আন্দোলনে নিহত ওয়াসিম নামে ফ্লাইওভারের নামকরণের দাবি
কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট


বিআইডব্লিউটিএ-এর ‘অবৈধ’হস্তক্ষেপ!:

জেলা পরিষদ কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটটি সংস্থাটি যুগ যুগ ধরে পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ ঘাটটি ২০১২ সালে মো. আবুল কাসেম রাজা নামের এক ব্যক্তিকে ইজারা দিলে শুরু হয় বিরোধ। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালত ডিভিশনে ১১৫১৭/২০১৩ নম্বর রিট দায়ের হয় যেখানে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের অনুকূলে রায় দেওয়া হয়। শুধু বিআইডব্লিউটিএ নয়, এক পর্যায়ে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে বসে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনও (বিআইডব্লিউটিসি)। একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনে সিভিল পিটিশন নম্বর ২৭২৩/২০১২ এবং ২৭২২/২০১২ দায়ের করা হয়, সেবারও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের পক্ষে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয়। ঘাটের মালিকানা ও পরিচালনা সংক্রান্ত চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের পক্ষে সর্বোচ্চ আদালতের রায় থাকার কারণে উক্ত ঘাট নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ বা বিআইডব্লিউটিসি’র হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। রায়ের পর বিআইডব্লিউটিসি ঘাটের মালিকানা থেকে সরে গেলেও বিআইডব্লিউটিএ-মালিকানা দাবি করে ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয়।

জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ-এর মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্বের শুরুটা হয় মূলত ২০২১ সালে। ২০১৩ সালে কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটটির ইজারা নিয়ে বিআইডবিউটিএ ও জেলা পরিষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে জটিলতা নিরসনে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের উদ্যোগে স্থানীয় দুই সাংসদ (চট্টগ্রাম ৩ ও চট্টগ্রাম ৪), বিআইডবিউটিএ ও জেলা পরিষদ-চট্টগ্রাম এর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরীঘাট পরিচালনা নিয়ে বিআইডবিউটিএ ও জেলা পরিষদের সাথে ৬ বছরের সমঝোতা হয়। সমঝোতা অনুসারে এই ঘাটের সম্পূর্ণ ইজারা ব্যবস্থাপনা জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হবে।

চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জেলা পরিষদ নতুন করে সমঝোতা চুক্তি করতে চাইলে না করে বসে বিআইডবিউটিএ। সংস্থাটির যুক্তি ছিল-২০২০ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফেনী থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত পুরো এলাকাকে নৌ-বন্দর ঘোষণা করে সরকার। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ-কে নৌ-ঘাটগুলো পরিচালনার দায়িত্বও দেওয়া হয়। সেই আইন অনুযায়ী নৌ ঘাটটি পরিচালনা করতে চায় বিআইডব্লিউটিএ। যদিও আদালতের রায় ছিল যুগ যুগ ধরে পরিচালনা করে আসা জেলা পরিষদের পক্ষে।

আদালতের রায় থাকার পরও বিআইডবিউটিএ অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করেছেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল। তিনি বলেন, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি জেলা পরিষদকে সুষ্ঠুভাবে ঘাট পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। ঘাটটি যে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিলাট ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের একটা রায় আছে। এরকম আপিলাট ডিভিশনের একটা রায়কে উপেক্ষা করে অন্য কেউ মালিকানা দাবির সুযোগ নেই। সবপক্ষের সম্মতিতে সম্পূর্ণ বৈধ এক্তিয়ার নিয়ে জেলা পরিষদের ঘাট পরিচালনাকালে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি বা অন্য কোনো পক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ শুধু আইনের বরখেলাপ নয়, ঘাটের পরিবেশ ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়নেও অনাকাঙ্ক্ষিত বাঁধা।’ শাব্বির ইকবাল সুষ্ঠুভাবে ঘাট পরিচালনায় সবপক্ষের সহযোগিতা চান।

তবে বিআইডব্লিউটিএ-চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘এলাকাটি নৌ বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। এ কারণে এই ঘাটে অন্য কারো কর্তৃত্ব করার সুযোগ নেই। সেজন্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছর থেকে আমরা পরিচালনা করে আসছি।’

বর্তমানে জেলা পরিষদের ইজারাদার মেসার্স আদিল এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আজমাইন আদিল চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানটিকে ইজারা হিসেবে প্রতিদিন ভ্যাটসহ ৯৩ হাজার ৫০০টাকা করে পরিশোধ করতে হয় জেলা পরিষদকে। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ-এর ইজারাদার হিসেবে আছে মেসার্স আর কে এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. জগলুল হোসেন নয়নকে ইজারা হিসেবে বছরে ভ্যাটসহ প্রায় ৮২ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ-কে।

ভোগান্তিতে দ্বীপবাসী:

এক ঘাট নিয়ে দুই সংস্থার রশি টানাটানিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে আছেন দ্বীপবাসী। একটি ঘাট দুই পক্ষ বড় অঙ্কের টাকায় ইজারা দিলেও ঘাটের উন্নয়নে কাজ করছে না কেউই। ফলে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামে আসা-যাওয়ার নৌপথে যাত্রীদের জন্য দুর্ভোগ অপেক্ষা করে বাঁকে বাঁকে। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে সরকার ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছিল দুটি জেটি। বিআইডব্লিউটিএ-এর মাধ্যমে নির্মিত এই দুই জেটির কোনোটি থেকেই প্রত্যাশিত সুফল পায়নি সন্দ্বীপবাসী। সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া অংশে নির্মিত জেটির একাংশ ভেঙে যায় উদ্বোধনের পাঁচ মাসের মাথায়। আর চট্টগ্রামের কুমিরা অংশে ভেঙে যায় ২০২২ সালের মে মাসে। মাত্র ১০ বছরে দুটি জেটির এমন দশায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। জেটি থাকলেও ভাটার সময় কোমরসমান পানি ও কাদামাটি মাড়িয়ে তীরে উঠতে হচ্ছে যাত্রীদের। জাহাজে করে আসা যাত্রীদেরও ‘লাল বোটে’ করে এনে কোমরসমান পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে চরম ঝুঁকি নিয়ে ওঠানামা করছে শিশু, বয়স্ক, নারী ও অসুস্থ রোগীরা। শুধু তাই নয় আবহাওয়ার পরিবর্তন হলেই যেন স্তব্ধ হয়ে যায় দ্বীপের মানুষের জীবন। সন্দ্বীপবাসীদের আশা দ্রুতই দুই সংস্থার বিরোধ মিটবে। তাহলে তাদের যাতায়াতে যেমন কষ্ট কমবে, ভোগান্তিও দূর হবে।

Scroll to Top