আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছায় না বন্যার্তদের কাছে

আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছায় না বন্যার্তদের কাছে

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চর দক্ষিণ বালাডোবা চরের বাসিন্দা ইবাত আলী। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ইতোমধ্যে তার থাকার ঘরের চাল পর্যন্ত পানি উঠেছে। একটি টিলায় ৪ টি গরু রাখলেও গত ৩ দিনের ধারাবাহিক পানি বৃদ্ধির ফলে সেই টিলাতেও পানি উঠেছে। গত দুই দিন ধর গরুগুলো অন্যত্র নেয়ার জন্য নৌকা খুঁজছিলেন তিনি। ৩ দিন গরুগুলো হাটু পানিতে থেকে পায়ে পচন ধরা শুরু হয়েছে। বুধবার (৩ জুলাই) বিকেলে নৌকা ভাড়া নিয়ে গরুগুলো পাশের বাজারের উঁচু ভিটায় রাখতে যাওয়ার পথে তিনি বলছিলেন, ‘ভাবছিলাম আগের বারের মতো পানি আর বেশি উঠবেনা। কিন্তু ৩ দিন ধরে যা পানি বাড়তেছে তাতে বাড়িতে থাকা সম্ভব না। কখন পানি বাড়বে কখন কমবে সেই খবর আমরা পাইনা। মাঝে মধ্যে বাজার গেলে শুনি।’ 

শুধু ইবাত আলী একাই নন। কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত চরাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবারগুলোর অধিকাংশ পরিবারগুলোর কাছেই পৌঁছায় না বন্যার আগাম সতর্কবার্তা। চরাঞ্চল গুলোতে নদীর পানি বৃদ্ধি শুরু হলেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নৌকার অভাবে অধিকাংশ পরিবারগুলোকে নির্ভর করতে হয় অন্যের নৌকার উপর। অথবা বেশি ভাড়া দিয়ে নৌকা নিয়ে জরুরী কাজ সারতে হয়। বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন থাকায় মোবাইল ফোন গুলোতেও চার্জ করা সম্ভব হয়না। জরুরী কোনো প্রয়োজনেও যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় বন্যা কবলিত লোকদের। চরের লোকজনদের স্থানীয় বাজারে প্রতিদিন যাওয়ার প্রবণতাও কম। সপ্তাহে দু’দিন হাটে গিয়ে কেনাকাটা করে দ্রুত দিনের আলোতে বাড়ি ফেরার তাগিদ থাকে সবার। তাই বাজারে থাকা টিভিতে চোখ বুলানোর সুযোগও হয়না অনেকের।

আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছায় না বন্যার্তদের কাছে
সংকটের পাশাপাশি রয়েছে বন্যার আগাম সতর্কবার্তা না পাওয়ার আক্ষেপ


বুধবার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি বন্য কবলিত চর ঘুরে দেখে বার্তা ২৪.কম। বিভিন্ন সংকটের পাশাপাশি বন্যার আগাম সতর্কবার্তা না পাওয়ারও আক্ষেপ করেন অনেকে। তারা জানিয়েছেন, বন্যার কয়েকদিন আগে পানি বৃদ্ধির খবর জানলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম হতো। বিশেষ করে গবাদিপশু গুলোকে নিরাপদে উঁঁচু স্থানে রেখে আসা যেত। 

বতুয়াতুলি মুসার চরের মন্টু মিয়া বলেন, ‘সরকারের ঘোষণা তো পাইনা। বাজারে যাই, চায়ের দোকানে টিভিতে যা খবর পাই তা নিয়ে থাকি। প্রতিদিন তো বাজারে যাই না। সপ্তাহে দুই দিন হাটে যাই। টিভিতে খবর দেখেছি পানি বাড়তেছে। কিন্তু এতটা বাড়বে জানা ছিল না। কিছু জিনিসপত্র ভেসে গেছে। মুরগি মারা গেছে কয়েকটা। আগে জানলে আত্মীয়র বাড়িতে রেখে আসতাম।’

বন্যাকালীন পরিস্থিতে জরুরী ভিত্তিতে লোকজনের কাছে খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে থাকে স্থানীয় প্রশাসন। বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, ‘আমাদের ইউপি সদস্যদের কাছে নিয়মিত আপডেট পৌঁছে দেয়া হয়। এছাড়াও, দূর্যোগ মোকাবেলা কমিটি, গ্রামভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে আমরা খবর পৌঁছে দেই। কি কারণে চরাঞ্চলের লোকদের কাছে তথ্য পৌঁছায় না আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’ 

কুড়িগ্রামের প্রায় ৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত


কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বলেন, ‘বন্যাকবলিত লোকদের কাছে সময়মতো পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা না পৌঁছানোর দায় কোনোভাবেই স্থানীয় প্রশাসন (ইউনিয়ন পর্যায়ের) এড়াতে পারেনা। এটি একটি সম্মিলিত কাজ। তথ্যের কোনো ঘাটতি নেই। আরও কিভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে দেয়া যায়, সে ব্যাপারে আমরা কাজ করব।’ 

ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬ টায় চিলমারী ও নুনখাওয়া পয়েন্টে এই নদের পানি বিপৎসীমার যথাক্রমে ৩৪ সেন্টিমিটার ও ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে এর অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে কয়েকটি উপজেলার হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়ছে ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি। এ অবস্থায় জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। 

জেলার দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ শাখা জানিয়েছে, কুড়িগ্রামের প্রায় ৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ৪০৪ টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬১ মেট্রিকটন চাল, ২হাজার ৯৬৭ প্যাকেট শুকনা খাবার ও নগদ ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। জরুরী স্বাস্থসেবার জন্য নিয়োজিত রয়েছে ৮৩ টি মেডিকেল টিম। 

Scroll to Top