আশফাক নিপুন: বিশ্বের অনেক বড় বড় শিল্পী আছেন, যাঁরা একজীবনে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে এত বড় গণ–অভ্যুত্থানের অংশ হতে পারেননি। সেখানে বাংলাদেশের মতো একটা জায়গায় একজন ক্ষুদ্র শিল্পী হিসেবে এত বড় মুভমেন্টের (আন্দোলন) সঙ্গে থাকতে পারলাম, এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া।
আন্দোলনের কনসিকুয়েন্স (পরিণতি) ভালো–খারাপ যা–ই হোক, ওই সময় জুলাই অভ্যুত্থানটা সঠিক ছিল। নিজের সক্ষমতা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, এই অভিজ্ঞতা আমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এই সরকার। স্বাধীনতা–পরবর্তী সরকার বাদ দিলে এতটা জনসমর্থন নিয়ে কোনো সরকার আসেনি।
গত এক বছরে বেশ কিছু জায়গায় সরকার কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ আমলের বড় বড় বাজেটের প্রকল্পগুলোর খরচ কমিয়েছে সরকার। এত লোন (ঋণ) ছিল, সেগুলো পরিশোধ করছে। এটা এই সরকারের অনেক বড় সাফল্য। আমরা এত দিন প্রায় মেনেই নিয়েছি, বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি হবেই। ঘুরেফিরে আমাদের পকেট থেকেই টাকা যাবে, আমাদের কিছু করার থাকবে না। এই সরকার সেই চর্চা থেকে বের হয়েছে। এত দিনে জানা গেল, মেগা বাজেটের ব্যয় কমানো সম্ভব।
সামনে নির্বাচিত সরকারকে প্রশ্ন করতে পারব, এত বড় বাজেট কেন হচ্ছে? তখন আমাদের অর্থনীতিবিদেরা এটা নিয়ে কথা তুলতে পারবেন। আগে চর্চাটা ছিল না। এবার হজ ব্যবস্থাপনাও দারুণ হয়েছে। বেঁচে যাওয়া টাকা হজযাত্রীদের ফেরতও দেওয়া হলো। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে, সেটাও বিশাল ব্যাপার। আমরা এত দিন ধরে জেনে এসেছি, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। রোজা এলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াবে, এটা মেনেই নিয়েছিলাম। সেখান থেকে বের হওয়া যায়, সেটা সরকার দেখিয়েছে।
১৫ বছরের অপশাসনের ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ক্ষমতায় এসে সরকার এক বছরের মধ্যে দেশটাকে স্বর্গ বানিয়ে ফেলবে—আমি এটা বিশ্বাস করার মতো বোকাও না। রাতারাতি দেশটা ঠিক হয়ে যায় না, সেটা আমি মানি। তার মধ্যেও কিছু বিষয় আমাকে হতাশ করেছে। প্রথমত, সরকার গঠনের দু–তিন মাস পরও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদেরা দেশ থেকে পালাতে পেরেছেন—এটা খুবই হতাশার। জুলাই আন্দোলনের স্পিরিটের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক। অনেক বড় বড় নেতা দেশের ভেতরে ছিলেন, এঁদেরকে কেন ধরা গেল না? এটা বড় ব্যর্থতা।
দ্বিতীয়ত, মবের আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। একটা সুন্দর রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিল; বিচার বিভাগ, পুলিশ থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও দুর্নীতি ঢুকেছিল। মব দিয়ে নয়, প্রতিষ্ঠান দিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা। মব ও তৌহিদি জনতার নামে কিছু লোক মানুষকে হেনস্তা করছে। আপাতদৃষ্টে অনেকে এটাকে ঠিক বলে মনে করছেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলাফল খুবই ভয়ংকর।
মাজারে হামলা থেকে শুরু করে যা যা হয়েছে, এটাকে ডিল করতে না পারাটা একটা বড় ব্যর্থতা। সরকার অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছে, অনেক জায়গায় ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু অ্যাকশন নেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রভাব পড়েনি। ছিনতাই, রাহাজানির ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকেছে, রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না। এই সব জায়গায় আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। এর মধ্যে অনেক ধরনের মামলা–বাণিজ্য দেখতে পাচ্ছি। এক মামলায় ২০০ থেকে ৩০০ আসামি করা হচ্ছে, যাঁদের সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্কই নেই। এই চর্চাটা গত সরকারের আমলে দেখেছিলাম। যে কাউকে মামলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এই সরকারে এই চর্চাটা কেন করবে?