পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন জুম চাষ। পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কেটে বপন করা বিভিন্ন ধরনের বীজ থেকে ফলানো হয় ফসল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়া এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বান্দরবানে জুমের বাম্পার ফলন হয়েছে। জুমের পাকা ধানে রঙিন হয়ে উঠেছে পাহাড়।
জেলার লামা, আলীকদম, নাইক্ষংছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়ে পাহাড়ে জুম চাষে উৎপাদিত পাকা ধানসহ মিশ্র সবজি ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জুমিয়ারা।
বিজ্ঞাপন
পার্বত্য অঞ্চলে লাঙ্গলে চাষাবাদ জমির পরিমাণ কম হওয়ায় উপজাতীয়রা আদিযুগের প্রথানুযায়ী জুম চাষ পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করে থাকেন। প্রতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুম চাষের জন্য মালিকানাধীন কিংবা পরিত্যক্ত ঘন বন-জঙ্গল, পাহাড় নির্বাচন করে জঙ্গল কাটা শুরু হয়। জঙ্গলগুলো প্রখর রোদে শুকানোর পর মার্চ-এপ্রিল মাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করা হয়। এপ্রিল মাস জুড়েই পাহাড়ের এসব জায়গা পরিষ্কার করে প্রস্তুতি নেওয়া হয় ধান বপনের। তখন কেবল বৃষ্টির অপেক্ষা। প্রথম বৃষ্টিতে ধান বীজ বপন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন তরিতরকারি বীজসহ নানা প্রকার ওষুধি, সবজি রোপণ করা হয়।
বর্তমানে জুম চাষের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে-মারপা (শশা জাতীয়) বরবটি, শিম, বেগুন, চিকন মরিচ, ধনিয়া, কুমড়া, ঢেঁড়স, বাতিমা, কচু, আদামরিচ, তিল ভুট্টাসহ প্রায় ৪০ প্রকারের বর্ষাকালীন সবজি। এসব সবজি পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিটি হাটবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি হাটবারে বিভিন্ন জেলার কাঁচামালের ব্যবসায়ীরা পাইকারী হারে তা ক্রয় করে ট্রাক ভর্তি করে চালান করছে সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, বান্দরবান জেলায় ২৮ হাজার পরিবার জুমের আবাদ করেছে। এ বছর জুম চাষের লক্ষ্যমাত্রা সাত হাজার ৪৬০ হেক্টর নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে আট হাজার ২৬৭ হেক্টর জমিতে। ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ মেট্রিক টন যা ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে।
লামা উপজেলার মিরিঞ্জা মুরুং পাড়ার বাসিন্দা মেনকন মুরুং বলেন, এবার জুমের ফসল উৎপাদন ভালো হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা হওয়ায় সারাদেশে যখন সবজি ও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ঠিক সে সময়ে আমরা দেশজুড়ে সবজি সরবরাহ করছি। দাম ভালো হওয়ায় চাষীরা লাভবান হবেন।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. হাসান আলি বলেন, চলতি বছর জুমের ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ মেট্রিক টন যা ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় আট হাজার তিনশো হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। জুমে ধান ছাড়াও সাথি ফসল হিসেবে মরিচ, বরবটি, মারফা, চিনার, মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টাসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে সকল উপজেলায় জুম চাষির সাথে সরকারি সকল সেবা পৌঁছে দিয়েছে।
জুম চাষিদের নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে জানিয়ে হাসান আলী বলেন, জুমের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি বিভাগ কৃষকদের স্থানীয় জাতের সঙ্গে হাইব্রিড জাতীয় ধানসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে।
এদিকে, দুর্গমে বসবাসরত জুম চাষিদের যাতে খাদ্য সংকটে দুর্ভোগে পোহাতে না হয় সে জন্য বান্দরবানের সাত উপজেলার পাহাড়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউএনডিপি। ৫৮৪টি রাইস ব্যাংকের মাধ্যমে সংগঠনটি আপৎকালীন খাদ্য মজুতের পদ্ধতি শেখাচ্ছে তাদের।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করে জুমের ধান জমা রাখছেন ব্যাংকে। যে ব্যাংক বিপদে-আপদে দুর্গমে বসবাসরত মানুষের পাশে থাকে। এই ব্যাংক থেকে সঞ্চয় রাখা ধান যে কেউ ধার করে চালতে পারে। পরবর্তীতে আবার ফেরত দিতে হয় ধার নেয়া ধানগুলো।
‘রাইস ব্যাংক’ হলো ধানের মজুতের একটি সম্প্রদায়ভিত্তিক সঞ্চয়স্থান, যা মূলত জুম চাষিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখান থেকে তারা ফসল কাটার আগে খাদ্য সংকটের বার্ষিক তিন মাসের সময়কালে চাল ধার করতে পারেন। জুমের ফসল ঘরে তোলার পর আবার তা শোধও করে দেন।
মূলত প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে মজুতের চাল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় সবাই ঘরে ঘরে নতুন জুমের ফসল নিয়ে আসেন। কিছু ফসল জমা রাখেন রাইস ব্যাংকে। যে কেউ ব্যাংক থেকে প্রতিবার ১০ থেকে ৫০ মণ চাল ধার করতে পারেন, যা প্রতিটি ১০ হাঁড়ির বিপরীতে অতিরিক্ত তিনটি পাত্র দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। রাইস ব্যাংক চাল বিক্রি করে আবার নগদ ধারও দেয়। ধার করা নগদ অর্থ প্রতি ১০০০ টাকায় অতিরিক্ত ১০০ টাকা দিয়ে দিতে হবে। আর বিশেষ ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয়। ধার নেওয়া অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দিতে হয়।
থানচি উপজেলার বড়মদক এলাকার একটি রাইস ব্যাংক কমিটির সভাপতি সাচিংপ্রু মারমা বলেন, বড়মদকে রাইস ব্যাংক ১৮ বছর ধরে কাজ করছে, যা জুম চাষিদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে।
রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুশৈথুই মারমা বলেন, জুম চাষি ও গ্রামবাসীরা ধানের ব্যাংক থেকে উপকৃত হচ্ছেন। প্রতি বছর জুম ধান কাটার আগে দুই থেকে তিন মাস অনেক মানুষ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়। তারা রাইস ব্যাংক থেকে চাল ধার করে চলতে পারে।