দুধ-মাংসের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে চায় ‘ফারমার্স মার্কেট’

দুধ-মাংসের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে চায় ‘ফারমার্স মার্কেট’

কুষ্টিয়ার আবু মিয়া। ছোট খামারি। স্থানীয় বাজার থেকে গরু কিনে রাজধানীতে নিয়ে আসেন বিক্রি করতে। এজন্য তাকে পদে পদে চাঁদা দিতে হয়েছে। তিনি জানান, দুই-চার টাকা লাভের আশায় অন্যের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এত দূর থেকে গরু নিয়ে ঢাকায় আসেন। আসার সময় রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। আবার গাবতলী ব্রিজ পার হলেই গরু নামাতে টাকা দিতে হয়।

চুয়াডাঙ্গার খামারি মোতালেব রহমান গাবতলীর গরুর হাটে কোরবানির গরু বিক্রি করতে একই সমস্যার কথা বলেছিলেন। তিনি জানান, আমার রাজাবাবু (গরুর নাম) এখানে রাখার জন্য হাসিল ছাড়া ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

Bkash July

রহিম মিয়া ও আতাউর রহমান গত বছরের কোরবানির সময় গাবতলী হাটে আসা অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন। শুধু গাবতলী হাট নয়, সারাদেশের খামারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে রাজধানীর বিভিন্ন হাটে যে পশু নিয়ে এসেছিলেন তাদের অধিকাংশের অভিজ্ঞতা এমন। খামারিদের এমন দুরবস্থা রোধে ও ভোক্তাদের সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ গরু ও খাসির মাংসসহ দুগ্ধজাত পণ্য পৌঁছে দিতে রাজধানী ঢাকায় ‘ফারমার্স মার্কেট’ চালু করতে চায় খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। এজন্য ঢাকার অঞ্চলভেদে কৃষক বা খামারিদের জন্য আলাদা মার্কেট বা দোকান (স্টল) বরাদ্দ চায় সংগঠনটি। এজন্য সিটি করপোরেশন বা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা চায় সংগঠনটি।

তৃণমূলের খামারিরা সরাসরি এই ফারমার্স মার্কেটে সাশ্রয়ী মূল্যে গরুর মাংস, খাসির মাংস, দুধ, পনির, ঘি দইসহ দুগ্ধজাতপণ্য বিক্রি করার সুবিধা পাবেন। সেইসঙ্গে ভোক্তা সাশ্রয়ী মূল্যে ‘নিরাপদ’ পণ্য পাওয়ার পাশাপাশি খামারিরাও লাভবান হবেন। তারা মনে করছেন, ‘ফারমার্স মার্কেট’ চালু হলে উভয়পক্ষই মধ্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকেও মুক্তি পাবে। জানা গেছে, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের আদলে এই ফারমার্স মার্কেটের প্রস্তাবনা নিয়ে ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছে।

Reneta June

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর ঈদে কোরবানির জন্য ৯৮ লাখ পশুর সম্ভাব্য চাহিদার বিপরীতে এক কোটি ২২ লাখ পশু ছিল। এরমধ্যে গরু ছিল ৫৫ লাখ। যা ওই সময় কোরবানির জন্য গরুর সম্ভাব্য চাহিদার তুলনায় পাঁচ লাখ বেশি। তার আগের বছর কোরবানির জন্য গরু ছিল ৪৬ লাখ। বিক্রি হয়েছিল ৩৮ লাখ। দুই বছর আগে কোরবানির গরু ছিল ৫৫ লাখ। সেখানে উদ্বৃত্ত ছিল নয় লাখ গরু। খামারিদের সমিতির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুই বছর ধরে আট থেকে নয় লাখ গরু উদ্বৃত্ত ছিল। তাদের দাবি, দেশে এখন ছোট বড় ১৭ লাখ গরুর খামার রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট হাটগুলোতে নির্ধারিত খাজনা বা হাসিলের চেয়ে বেশি টাকা আদায় করে ইজারাদাররা। এজন্য রসিদও দেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও মাংস ব্যবসায়ী হিসেবে তাদের কম টাকার খাজনা দেয়ার সুবিধা পাওয়ার কথা। ইজারাদার খাজনা বেশি হারে আদায় করলেও আগে চামড়া বিক্রি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারত ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার বাজারে মন্দার কারণে সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে পশু কেনার পর জবাই করে মাংস বিক্রির বদলে ব্যাপারিদের মতো জীবিত পশু সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে মাংস ব্যবসায়ীরা।

রমজান উপলক্ষে রাজধানীতে সরকারি উদ্যোগে ‘সুলভ মূল্যে’ দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি হচ্ছে। সেখানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে পণ্য দিয়ে সহায়তা করছে বিডিএফএ। সেখানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৪০ টাকায় (বাজারমূল্য কেজিপ্রতি ৭৫০ টাকা), খাসি প্রতি কেজি ৯৪০ টাকায় (বাজারমূল্য ১১০০ টাকা), ড্রেসড ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ৩৪০ টাকায়, দুধ প্রতি লিটার ৮০ টাকায় (৯০ টাকা) এবং ডিম প্রতি পিস ১০ টাকায় (বাজারে ১২ টাকা) কিনতে পারবেন। তবে গত বছর প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫৫০ টাকা, খাসির মাংস ৮০০ টাকা, ড্রেসড ব্রয়লার ২০০ টাকা, প্রতি লিটার দুধ ৬০ টাকা ও এক হালি ডিম ৩০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২৪ রমজান পর্যন্ত ৪৫ টন গরুর মাংস, ৩ টন ছাগল, ৯ লাখ ৬০ হাজার ডিম, ড্রেসিং ব্রয়লার ৩০ টন এবং প্রায় ৪ হাজার লিটার দুধ বিক্রি হয়েছে। ইতোমধ্য কার্যক্রমটি মানুষের মাঝে ‘ব্যাপক’ সাড়া ফেলেছে। প্রতিটি গাড়ির পেছনে দীর্ঘ লাইন। সেখান থেকে পণ্য কিনলে একজন ক্রেতার ১১০ থেকে ১৮০ টাকা সাশ্রয় হয়। রমজানের সময় এই উদ্যোগের সুবাধাভোগী হয়েছেন অন্য ধর্মাম্বলীরাও।

ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে যে ফারমার্স মার্কেট আছে সেখানে কৃষক বা খামারিরা সরাসরি ওই মার্কেটে পণ্য সরবরাহ করে থাকে বলে জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা খামারিরা সরাসরি ফারমার্স মার্কেটে গরু ও খাসি সরবরাহ করব। যেখানে খামারির গরু ও খাসির মাংস ভোক্তাদের কাছে সরাসরি বিক্রি হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন যেটা হয় সেটা হলো মাঠপর্যায়ের কোন খামারি বা কৃষকের কাছ থেকে কিংবা স্থানীয় হাট থেকে গরু-খাসি-ছাগল কিনে তা কমপক্ষে দুই তিন হাত বদল হয়ে ঢাকায় কসাইরা জবাই করে বিক্রি করেন। এতে মাংসের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। যখন সরাসরি খামারিরা ফারমার্স মার্কেটের নির্ধারিত দোকানে গরু-খাসি সরবরাহ করবেন এতে আর মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। এতে ভোক্তারা নির্ভেজাল জিনিস পাবেন এবং বাজারমূল্য থেকে কম দামে পাবেন। অর্থাৎ ভোক্তারাও লাভবান হবেন, খামারিরাও লাভবান হবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু গোশত নয়, খামারে উৎপাদিত দুধ, খামারিদের তৈরি পনির, দধি, ঘি, বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন বিক্রি হবে ফারমার্স মার্কেটে। আমরা একটা মার্কেট বানাব, যেখানে সারাদেশ থেকে খামারিরা তাদের পণ্য নিয়ে আসবে। ডেইরি অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমরা ভোক্তাদের নিশ্চিত করব যেসব পণ্য ফারমার্স মার্কেটে থাকবে সেগুলো শতভাগ নিরাপদ ভেজালমুক্ত পণ্য।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘কেউ যদি সুলভ মূল্যে, সহজেই ভোক্তাদের হাতে নিরাপদ খাবার পৌঁছে দিতে চায় তবে আমরাও এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। যেকোন ভালো উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে ডিএনসিসি।’

Labaid

Scroll to Top