১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন লাল সবুজ পতাকাটি পেয়েছে, এটা অবধারিত সত্য। তার সূত্র ধরে বাংলার জনগণের চাওয়া ছিল স্বাধীন দেশে নিজেদের মত করে দেশটাকে গড়ার। যেখানে থাকবেন না পরাধীনতার শিকল। থাকবে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়বার মত পরিবেশ।
মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশ থাকবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু দুঃখিনী মায়ের সন্তানরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও লড়াই করছে নিজেদের মৌলিক অধিকারগুলোর জন্য। নানা সময়ে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আর সে ধারাবাহিকতায় ২৪ এর জুলাই সব আন্দোলনকে ছাড়িয়ে গেছে। নিজের দেশের মানুষকে গুলিতে নিহত করেছে ১৯৭১ সালের মহানায়কের কন্যা শেখ হাসিনা। এটা সত্যি স্তব্ধ করে দিয়েছে দেশকে। একজন মা কি করে মায়ের বুক খালি করে তা ভাবা অসম্ভব। ক্ষমতার স্বাদ এতটাই মানুষকে অন্ধ করে তার জলন্ত উদাহরণ হয়ে গেল শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের লড়াইগুলো কোন ভিন্ন দেশের সাথে হয়নি। সকল লড়াই হয়েছ দেশের শাসক গোষ্ঠীদের সাথে। এ লড়াইয়ের সূত্রপাত্র হয় নানা সময়ে নানাভাবে। তবে ১৯৭১ সালকে নিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি হয় তা অত্যন্ত বিপদজনক। দেশের মধ্যে নিজেদের অজান্তে দুটি পক্ষ জন্ম নেয়। একদল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি অন্যটি হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। এখানেই শেষ নয়। সময়ের পরিক্রমায় দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নেই শুরু করে বিবাদ। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা এককভাবে মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের সম্পত্তির হিসাব মনে করতে থাকে।
অন্যদিকে, বিএনপি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে। এর দ্বারা তারা মনে করে মুক্তিযুদ্ধ সফল হত না জিয়ার ঘোষণা ছাড়া। কিন্তু চিরায়ত সত্য হল, শেখ মুজিবর রহমানের ৭ মার্চের ঘোষণায় দেশ প্রস্তুত হচ্ছিল যুদ্ধের জন্য। আর ২৫ মার্চের কালো রাত্রির ঘটনায় দেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নেয় পাকিস্তানের বিপক্ষে। বাঙালি সেনা সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা বাঙালি সেনাদের মনোবলকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
জিয়াউর রহমানের ‘একটি জাতির জন্ম’ লেখায় এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। সব কিছুকে ছাড়িয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নানাভাবে ইতিহাসকে নিজেদের মত করে লিপিবদ্ধ করেছে তাদের শাসন আমলে। আসলে এককভাবে কেউই মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার হতে পারে না। কারণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হলো জনযুদ্ধ। হাতে গোণা কিছু ছাড়া দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার কোন না কোনভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
বাঙালি বড় দূর্ভাগা জাতি। তাই স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অতি দাম্ভিকতার কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে অপমানিত হতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কোনদিন কোনকালেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ শেখ পরিবার বা আওয়ামী লীগের একক সম্পত্তি ছিল না। বিগত ১৬ বছরে যা ভুল হয়েছে তার দায় কেবলমাত্র শেখ হাসিনা আর তার দুর্নীতিবাজ দোসরদের। সেখানে মুজিববাদ বলে কিছুই ছিল না। বর্তমান প্রজন্ম যদি শেখ মুজিবের শেষ ভাষণটি বিশ্লেষণ করে তাহলে বুঝতে পারত ১৯৭২ পরবর্তী সময় নিয়ে কতটা হতাশাগ্রস্থ ছিলেন তিনি। তার কন্যা পিতাকে অনুসরণ করে নাই বলে আজ দেশ থেকে বিতাড়িত। এ নির্মম সত্যকে যদি শিক্ষনীয় হিসাবে গ্রহন করে বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো তাহলে হয়ত নতুন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন থাকবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা বিতাড়িত হলেও এ দেশে এখনো বহাল তবিয়তে আছে দুর্নীতি, চাদাঁবাজি, দখলদারিসহ নানা অপকর্ম। এসব দেখে মনে হয় ক্ষমতার পালাবদল হয় কিন্তু সাধারণ জনগনের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।
২৪ এর জুলাইতে শেখ হাসিনার একটি তাচ্ছিল্যকর শব্দ ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ শুনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জনগণও রাস্তায় নেমে আসে প্রতিবাদ জানাতে। সন্তানকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করে নাই মৃত্যু হতে পারে জেনেও। সেদিনগুলোতে আওয়ামী সরকার প্রধানের হিংস্ররূপ দেখে বিস্মিত হয়েছে সারাদেশ। একজন মায়ের সন্তানের লাশ হাজারো মাকে কাঁদিয়েছে। স্বাধীন দেশের এমন গুলির শব্দ মেনে নেয়ার মত কোন যুক্তি ছিল না। হাজারো মায়ের বুক খালি করে দিয়েছে আরেক মা। এমন বাংলাদেশ কারো প্রত্যাশায় ছিল না সে সময়। তাই মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সন্তান হারা মায়েদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এটা কোন রাজনৈতিক দল বা দলের প্রধান হিসাবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। বিবেকবান মানুষ হয়ে ভাবা উচিত। মানুষের জীবন ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়—এ বাস্তবতাকে মানতে পারলে মানুষ কখনো হিংস্র মনোভাব লালন করতে পারে না।
শেখ হাসিনার যবনিকাপাতের এক বছর পার হল। সন্তানহারা মায়েদের শোক কোনদিন কেউ ভুলিয়ে দিতে পারবে না। তবে তারা চায় তাদের সন্তানদের স্বপ্নটা সত্যি হোক। কিন্তু ক্রমশ সে স্বপ্ন যেন দূর আকাশের তারা হয়ে উঠেছে। কারণ অন্তবর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনুস আর উপদেষ্টা পরিষদের টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে সুবিধাবাদীরা। কখনো এ সরকার পরিস্কার কিছু বলতে পারে না। কোটা বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল নতুন প্রজন্ম দেশকে নিয়ে ভাবে। তারা কেবল মোবাইল আর ইন্টারনেট ব্যস্ত থাকে না। তাই তরুণদের দেখা স্বপ্নের বাংলাদেশ সবার স্বপ্ন হয়ে উঠলেও আজ সে স্বপ্ন ক্রমশ চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাও নিজেদেরকে এমপি বা মন্ত্রী হিসাবে দেখতে চায়। আর এ কাজটার বীজ বপন করেছে ছাত্রদেরকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করার মাধ্যমে। ইতিহাসের ব্যতয় ঘটিয়েছে জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ সারির নেতারা। প্রতিটি আন্দোলনের সূচনা ঘটায় ছাত্ররাই। বিজয়ের পর তারা ফিরে যায় তাদের পড়ালেখায়। এবার ও তাই হবার কথা। কোটা আন্দোলন শেখ হাসিনার অদূরদর্শিতার জন্য সরকার হটানোর আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল একথা যেমন সত্য; তেমনি জুলাইয়ের আন্দোলন সফল হবার পর ছাত্রদের পড়ালেখা আর ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে সরকার ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ করাটা হত যথাযথ। তা না করে তারা যখন সরকার ও বিভিন্ন স্থানে পদবী নিয়ে আসীন হয়, তখন তারা তাদের আন্দোলনের শপথ ভুলে গিয়ে ভুল পথে চলতে শুরু করে।
সোজা কথায় বলা যায়, ক্ষমতা আর অর্থের মোহ থেকে তারা আলাদা হতে পারছে না। গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় দেশে জন্ম নিয়েছে নতুন আরেকটি দল এনসিপি। তাদের ভাষ্যমতে, বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকারের নাগরিক অধিকার ও সুবিধা পায়নি। এ ৫৩ বছরের ইতিহাসে কেবলমাত্র মাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না। এ দেশকে শাসন করেছে সামরিক বাহিনী, বিএনপি, এরশাদ। ৯০-এর গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ-বিএনপি। সে অঙ্গীকার কোন দলই পালন করে নাই। বরং যে যার মত করে নিজেদের দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। যার ফলে লগি বৈঠার সংঘাতের সৃষ্টি হয়। সে সময় বিএনপি বিনাশের পথে চলে গিয়েছিল। জনগণ মনে করেছিল ১/১১ থেকে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ শিক্ষা নিবে। কিন্তু তা হয়নি বরং বিএনপির চেয়েও আর ভয়ংকর পথে চলতে থাকে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধকে আজ তাদের জন্য ক্ষত বিক্ষত হতে হচ্ছে।
তবে মুক্তিযুদ্ধ মানে আওয়ামী লীগ নয়। একথাটা বর্তমান প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে। আজ যে মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছে তা কিন্তু অনেক মানুষের রক্ত আর মা বোনের সম্ভ্রম হারানো বিনিময়ে পাওয়া। সে সাথে এটাও মনে রাখা উচিত ৭১ বিরোধী রাজনৈতিক দল হচ্ছে গোখরা সাপের মত। সুযোগ বুঝে তারা ছোবল দিবে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তরুণদের আওয়ামী ৭১ বিরোধী আবেগ তাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তাই প্রগতিশীল তরুণদের উচিত আওয়ামী দৃষ্টির বাইরে গিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটা বিষয় সুস্পষ্ট, ইউনুস সরকার এখন নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে চায়। শেখ হাসিনার সাথে তার ব্যক্তিগত সংঘাত রয়েছে। আর সেখানে ইউনুসের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে বাংলাদেশ শাসন করা বিশাল বিজয়। দুঃখজনক হল এটাই, হাজারো শহীদের রক্তের দাগ এখন আর সরকারকে আবেগতাড়িত করে না। জুলাই আন্দোলনের আবেগ যে হারিয়ে গেছে তার প্রমাণ হল, জুলাই ঘোষণাপত্র। এখন পর্যন্ত আওয়ামী সরকারের রাষ্ট্রপতি বহাল তবিয়তে। এ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের কোন উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ইউনুস সাহেব তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই ক্ষমতা বসেছেন। কিন্তু এখন তিনি তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার প্রথম বিনাশ ঘটিয়েছে তাদের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে। বছর না ঘুরতেই জুলাই আন্দোলনের ক্রেডিট নিতে ভাগাভাগি শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক দল আর ছাত্রদের মধ্যে। আন্দোলনকে যদি সত্যি সবাই ধারণ করত তাহলে অত্যন্ত ৫ আগষ্ট একসাথে পালন করত।
বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতির অংকে সবাই ধরে নিয়েছে আগামী সরকার গঠন করবে বিএনপি। এমন কথায় বলা যায়, এক ধরনের নির্বাচন হয়ে গেছে।এটা কি তথাকথিত রাজনীতির বাইরে কিছু ঘটবে বলে মনে হয়। তবে বিগত ১৬ বছরের একতরফা নির্বাচনের কারণে ভোটের অংকটা আগের মত নেই। এখন তরুণ প্রজন্ম আর আওয়ামী সমর্থকের ভোট নিয়ে ভাবতে হবে। এ হিসাবের বাইরে জামায়াত ইসলাম মনে করছে দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী তাদের অনুসারী। তবে এটা কতটুকু বাস্তবসম্মত সেটি দেখা সময়ের বিষয়।
সবকিছু মিলিয়ে জুলাইয়ের ৩৬ দিন এখন কেবল রাজনৈতিক ভাষণের একটা অংশ মাত্র। দলগুলোর ভাব ভঙ্গিতে মনে, হয় জুলাই ছিল তাদের ভোটের অধিকার পাওয়ার আন্দোলন; তা কিন্তু নয়। সত্য হল, মা বাবারা সন্তানদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যতে চেয়েছিল বলেই সন্তানদের গুলির মুখে প্রতিবাদ করতে যেতে সম্মতি দিয়েছিল। স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে শোষণহীন বৈষম্যবিরোধী সরকার পাবে কি পাবে না তা অনিশ্চিত।তাই তরুণদের দেখা স্বপ্ন কেবলই স্বপ্ন হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এটাই সত্য।
আজ এটা বলতেই হবে, বিগত ১৬ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে রাস্তায় নামাতে পারেনি। একইভাবে প্রবাসীদের পাশে পায়নি আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। কিন্তু দেশের মাটিতে নিজের সন্তানের মত আরেক মায়ের সন্তানের গুলিবিদ্ধ দেহ বা লাশ দেখে তারা বসে থাকেনি। সোচ্চার হয়েছিল। সব কিছুকে ভুলে গিয়ে জুলাই ঘোষণার নামে একটা দায়সারা দলিল দিয়ে ইউনুস সরকার জুলাইয়ের আন্দোলনের ছাত্রদের স্বপ্নকে বিনাশ করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এত বড় আন্দোলন বারবার হয় না। তাই তরুণ প্রজন্মের নেতাদের ভাবতে হবে তাদের চলার পথ নিয়ে। কারণ রাজনীতিতে আবেগের কোন দাম নেই।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)