আজীবন সুখের সন্ধান করা মানুষ জানু পেতে বসে অপেক্ষার দুয়ারে, পুজোর আর ১০০ দিন…

আজীবন সুখের সন্ধান করা মানুষ জানু পেতে বসে অপেক্ষার দুয়ারে, পুজোর আর ১০০ দিন…

Last Updated:

মৃত্যু মুছে নিকোনো হয় উঠোন, আলপনায় আঁকা হয় জীবনের পায়ের ছাপ।

News18আজীবন সুখের সন্ধান করা মানুষ জানু পেতে বসে অপেক্ষার দুয়ারে, পুজোর আর ১০০ দিন…
News18

আজ আকাশ অংশত মেঘলা। ঈশান কোণে ঘনিয়েছে মেঘ। সেই ‘বাদল মেঘে মাদল বাজে’। আঁধার করে আসে। মন ভার হয় ‘গোপন ব্যথা গোপন গানে’। বৈশাখ অতিক্রান্ত হয়েছে সে প্রায় অনেককাল। আষাঢ়স্য দিবসে কেজো কথায় মন লাগে না। উড়ে চলে দিকদিগন্তের পানে। তেতেপুড়ে ক্লান্ত মানুষগুলো চাতকদশা ঘুচল বটে, কিন্তু জানলা খুলে এমন বিষাদকালো আঁধারে কি আর দফতরে যেতে মন লাগে? প্রকৃতি খামখেয়ালে চলে, তার মাথার ওপর কেউ ছড়ি ঘোরানোর নেই। বিনুনি দোলানো কিশোরীও হয়তো বলতে পারে, ‘মাগো আমায় ছুটি দিতে বল…’ কিন্তু জাঁতাকলে ফেঁসে গিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের ছুটি দেবে কে! অলস লাগে। কত সুখস্মৃতি ভিড় করে! কাদামাখা ফুটবল মাঠ, জমাজলে ভেসে যায় কাগজের নৌকা। এ জনঅরণ্যে রেইনি ডে তো আছে, কিন্তু ছুটি কোথায়? এই মুখভার দিনও বয়ে আনে সুসংবাদ। শহর পেরিয়ে মফস্বলের অলি-গলি হয়ে শ্যামলসুন্দর ধরণীর সকলখানে গানে গানে ছড়িয়ে যায়, মনখারাপের বিকেলে ঠোঁটের কোণায় একচিলতে হাসি জানান দেয়, ‘পুজোর আর ১০০ দিন’।

পুজোর প্যালেটে রংতুলির কমতি নেই। এই তো আর ক-দিন। তারপরেই বড় চেনা সেই ছবিগুলো। ছবির মতো সাজানো কোনও গ্রামের গলির শেষে একটা বিউটি পার্লার। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসছে রংবেরংয়ের জামা, শোনা যাচ্ছে খিলখিলে হাসি। রোজ সন্ধেয় বাড়ির পর্দাওঠানো জানলা দিয়ে শোনা যায় পুজোর ফাংশানের রিহার্সাল। ঘোর বর্ষায় যে পুকুরের জল ছাপিয়ে উঠত, তারই ধারে ধারে গজিয়েছে কাশ। কেমন যেন ঘোর লাগে। ‘মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে’ কাশের বনে দোলা লাগে… শ্রাবণরজনী শেষে মিঠে রোদ আর সেই কাশফুল গাঁটছড়া বাঁধে। তিরতির করে কাঁপা পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় রৌদ্র-ছায়া। পুজোর গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকা এই দূরপ্রবাসী স্বজনের গন্ধ, নতুন জামা, কুড়োনো নারকোলের গন্ধ, চলার পথে নরম শিউলি, ছাতিমের ঘ্রাণ ভুলিয়ে দেয় যুদ্ধের কথা, মৃত্যুর কথা। স্টেশনে স্টেশনে ঘরে ফেরার তাড়া। ফেরার স্টেশন আর ফিরে যাওয়ার স্টেশন একই। শহর পেরিয়ে শহরতলির দিকে ছুটে চলে ট্রেন। জানলায় চোখ পাতলে দেখা যায় সাদা সবুজ কাশের বনে টুপ টুপ করে পড়ছে আকাশনীলের ফোঁটা। তবু দিনভেদে ছবি বদলায়। বেঁধে বেঁধে ধরে মায়া। মায়ের হাতে মাখা গ্রাসের মতো মায়া। অপু-দুর্গা গুনতে বসেছিল দিন।

এই পুজোর দিন গোনা বড় অদ্ভুত। যেদিন থেকে দিনগোনা শুরু, সেদিন থেকেই যেন পুজো। জীবন থেকে আনন্দ তো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। গহীন জলে ডুবুরির মতো খুঁজে চলি ছিটেফোঁটা সুখ। পুজোর ছুটি যেন সেই অনন্ত অবসর, সুখ খোঁজার। যেন অতিথি আসার আগে ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে…’  মালকোষ-ইমন-দেশ মিলেমিশে জানান দেয় আগমনবার্তা। সাজি ভরে শিউলি ফুল তুলে কাকিমা-জেঠিমাদের ঘরে দিয়ে আসছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’-এর সেই মেয়েটি। পাটভাঙা শাড়ির কুঁচিতে ঢেকে যাচ্ছে বচ্ছরভরের সঞ্চিত আবর্জনা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘সবুর সহে না আর/ জননীরে বারবার/ কহে মাগো ধরি তোর পায়ে

বাবা আমাদের তরে/ কী কিনে এনেছে ঘরে/ একবার দে না মা দেখায়ে’

পথের পাঁচালীতেও যেন সেই ছবি। পাতালকোঁড়ের তরকারিকেই মাংস ভাবা অপু-দুর্গার ঘুমজড়ানো চোখে পুজোর অপেক্ষা। আর ২২ দিন পরে বাবা আসবে। মেয়ের জন্য কাপড় আর আলতার পাতা নিয়ে হরিহর যখন বাড়ি ফেরে তখন তার বাড়ির দুগ্গার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। গরম রৌদ্রের গন্ধ, নীল নির্মেঘ আকাশ, বর্ষা শেষের সরস সবুজ লতাপাতা সব আছে, নেই শুধু সেই বালিকা। যে জীবন ফড়িংয়ের, তাতেও আনন্দ জাগে। সমস্ত মৃত্যুর পরেও উড়তে থাকে জীবনের ঘুড়ি। মৃত্যু মুছে নিকোনো হয় উঠোন, আলপনায় আঁকা হয় জীবনের পায়ের ছাপ। সারাজীবন সুখের সন্ধান করা মানুষ জানু পেতে বসে অপেক্ষার দুয়ারে, বিষাদগ্রস্ত বাঙালীর আজীবন শরৎকাল…

Scroll to Top