ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবে মাতোয়ারা পুরান ঢাকা

ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসবে মাতোয়ারা পুরান ঢাকা

ঢাকা: সকলের তীক্ষ্ণ আর তৎপর দৃষ্টি আকাশের দিকে। সেখানে পাখির মতো ডানা মেলে ওড়াউড়ি হাজারো রঙ্গিন ঘুড়ির। হঠাৎ করেই কেটে গেলো একটা নীল ঘুড়ির সুতো। একটা ঘুড়ির সুতো কাটতেই একদিকে সুর উঠলো ‘বাকাট্টা লট, লট…’ শব্দের। আরেক দল ভোঁকাট্টা হলেই ভোঁ-দৌড়। ছেলে-বুড়ো সবাই ছুট লাগাল কাটা পড়া চোখদার সেই ‘ঘুড্ডি’ ধরতে। যে আগে পৌঁছাতে পারবে, ঘুড্ডিটা তার!

শুধু কি তাই? ঘুড়ি শিকারের জন্য লম্বা লগির মাথায় ঝোপঝাড় বেঁধে পুরান ঢাকার পথে পথে শিশু-কিশোরদের ছোটাছুটি চোখে পড়ার মতো। তাদের মাথার ওপর আকাশ রঙ্গিন ঘুড়িতে সয়লাব! সে ঘুড়ি পৌষ-সংক্রান্তি উৎসবের ঘুড়ি। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবের ঘুড়ি। নিজস্ব ঢঙে পুরান ঢাকার জনগন পালন করে পৌষ-সংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী এই ঘুড়ি উৎসব ‘সাকরাইন’। তাইতো ঘুড়ি এখানে ‘ঘুড্ডি’ আর ‘ভোকাট্টা’ হলো বাকাট্টা। পঞ্জিকামতে, বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন। এই দিনটি উপলক্ষে পুরান ঢাকায় উদযাপন করা হয় পৌষ-সংক্রান্তি। পুরান ঢাকার মানুষ একে বলে ‘সাকরাইন’। ঐতিহ্যের পরম্পরায় পৌষবিদায়ী এই উৎসবের অংশ হয়ে গেছে ঘুড়ি ওড়ানো। পুরান ঢাকার শাখারীবাজার, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, হাজারীবাগ, সদরঘাট, নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, ওয়ারী ও পোস্তগোলা এলাকার মানুষ এখনো ঘটা করে সাকরাইন উদযাপন করে।

আজ সাকরাইন উৎসব | Dhaka Tribune Bangla

এদিন এই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ সেজেছে সাকরাইনের আলোকে। গান-বাজনার তালে তালে সকাল থেকে শুরু হয়েছে ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনা। ফুটছে নানা রকম পটকা। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত হচ্ছে প্রতিটি বাড়ির ছাদ, চলছে ঘুড়ির সাম্যবাদ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে উৎসবের মুখরতা, বাড়ছে আকাশে ঘুড়ির সংখ্যাও। কে কার ঘুড়ি কাটতে পেরেছে সেই প্রতিযোগিতা আর ঘুড়ি কেটে ফেলার আনন্দ আর চিৎকার মোহ ধরিয়ে দেয় সবার। ছেলেদের সঙ্গে তরুণীরাও অংশ নিয়েছেন ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা ইভা বলেন, ১৫ বছর ধরে এই উৎসবটা করে আসছি আমরা। প্রতিবছর বন্ধুরা মিলে চাঁদা তুলে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করি এই উৎসব। চেষ্টা করি আয়োজনে চাকচিক্য আনার। ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি খাওয়ার জন্য থাকে খিচুড়ি আর মাংস। সারা দিন ছাদ কাঁপিয়ে বাজতে থাকে গান, চলতে থাকে নাচও।

সাকরাইন উৎসব - পৌষ সংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী উৎসব

আরেক ঘুড়ি অনুরাগী আরিয়া আমান জানালেন, বুধবার ছাদে তোলা হয়েছে বড় স্পিকার। আশপাশের কেউ যেন বাদ্যের আওয়াজে তাঁদের পেছনে ফেলতে না পারে, সেজন্য আনা হয়েছে ১০ পিয়ার বক্স। এটাও ঘুড়ি কাটার মতো একটা প্রতিযোগিতা। আর বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো শেষে সন্ধ্যার পর শুরু হয় মুখে কেরোসিন-আগুনের খেলা, ফানুস ওড়ানো। এছাড়া বাড়ির ছাদগুলো থেকে আকাশে ছোড়া হয় শাঁখারীবাজার, চকবাজার থেকে কিনে আনা রং-বেরঙের আতশবাজি। সাকরাইন উৎসব বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক উৎসব। এ উৎসব নিয়ে শাখারীবাজার এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ী আরাফ আহমেদ জানান, সাকরাইন আমাদের পুরান ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্য। ছোটকাল থেকে দেখে আসছি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আয়োজন করে আসছে। আগে পিঠা-টিঠা বানানো হতো। এখন বাড়িতে পিঠা বানানোর আয়োজন কমে গেছে। এছাড়া আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন নিজেরাই উৎসবের আগের দু-তিন ধরে ঘুড়ি বানাতাম, সুতোই মাঞ্জা দিতাম। তবে এখন তো সেসব নেই, সবকিছু এখন রেডিমেইড কিনতে পাওয়া যায়। তখনকার উৎসবের সঙ্গে এখনকার উৎসবের পার্থক্য ঢের। তবে উৎসব যে পরাম্পরায় টিকে আছে, বড় হয়েছে, এটাই ভালোলাগা।

ছবিতে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব - BBC News বাংলা

এদিকে প্রথমবারের মতো সাকরাইন উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে আয়োজিত হচ্ছে এই ঘুড়ি উৎসব। পৌষ-সংক্রান্তি উপলক্ষে উৎসবে অংশ নিতে আগ্রহীদের মধ্যে ঘুড়িও সরবরাহ করা হয়েছে। আর এই উৎসবের মধ্য দিয়ে ঢাকার ঐতিহ্যকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা হবে বলে উৎসবের উদ্বোধনী আয়োজনে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

এম এন বাংলা
নিউজ ডেস্ক

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ আগুন

Scroll to Top